পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ ও ফলাফল


পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা অন্যতম। বাংলা অভিধানে বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক শব্দ মিরজাফর। বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীরজাফর পবিত্র কুরআন শরিফ মাথায় রেখে নবাবের পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরপরই বেঈমানি করেছিল।
নবাব-সিরাজউদ্দৌলার-সিংহাসন-আরোহণ
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কতিপয় বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন। তাহলে জেনে নিন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ কি ছিলোঃ-

পেইজ সূচিপত্রঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ

নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ও বংশপরিচয়

সিরাজউদ্দৌলার জন্ম গ্রহন করেন ১৭৩৩ সালে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তার ছিল তিন কন্যা। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন পুত্র, নোয়াজিশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে শাহ বেগম এবং জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগম-এর বিয়ে দেন।

আমেনা বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ-উদ-দৌলা) এবং মির্জা মেহেদী। আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তার তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ-উদ-দৌলা)-এর জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে নাতি হিসেবে গ্রহণ করেন।

সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের, যেহেতু তার কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। তিনি মাতামহের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকেন। সিরাজ-উদ-দৌলার জন্মতারিখ বা সাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মীরজাফর তার কোন আত্মীয়ের মাঝে পড়েন না। কাজী ইসা তার চাচা হন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যাভিষেক

১৭৪৬ সালে আলিবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ তার সাথী হন। আলিবর্দি সিরাজ-উদ-দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তার বয়স অল্প ছিল বলে রাজা জানকীরামকে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু বিষয়টি সিরাজদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে পড়েন।

তিনি সোজা পাটনা গিয়ে উপস্থিত হন এবং জানকীরামকে তার শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু নবাবের বিনা অনুমতিতে জানকীরাম তার শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান। অন্যদিকে জানকীরামের আচরণে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে সিরাজদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে লড়াই শুরু হয়ে গেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলিবর্দি খাঁ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিনই আলিবর্দি খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন,

 আমার পরে সিরাজ-উদ-দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে। 

ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজ-উদ-দৌলার যৌবরাজ্যাভিষেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই সময়ে সিরাজ-উদ-দৌলার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। তবে তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলিবর্দি খাঁর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেশ মোহাম্মদ। এছাড়া আলিবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজউদ্দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ

মুর্শিদকুলী খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ পর্যন্ত সুবাহ বাংলার নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা শাসন করছিলেন। তার সময়ে তার পুত্র সরফরাজ খান ১৭৩৪ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত ঢাকার নায়েব নাজিম এবং ১৭৩৯ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় (১৭৩৯-১৭৪০) ঢাকার নায়েব নাজিম হন আবুল ফাত্তাহ খান।

প্রসঙ্গত, ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের সময় থেকেই নবাবগণ মুর্শিদাবাদে অবস্থান করতেন আর বাংলাদেশের জন্য তখন থেকেই একজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হতো। ১৭৪০ থেকে ১৭৪৪ পর্যন্ত আলীবর্দী খানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। তবে তিনি মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তার সহকারী হোসেন কুলী খান এবং হোসাইন কুলীর সহকারী হোসেন উদ্দিন খানকে (১৭৪৪-১৭৫৪) ঢাকায় দায়িত্ব পালন করান।

এ সময় থেকেই আলীবর্দীর ভ্রাতুষ্পুত্র শওকত্জংগ নওয়াজিস মুহাম্মদের বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধের জের হিসেবে ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খান এবং মুর্শিদাবাদে তদীয় চাচা নিহত হন। ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খানকে হত্যায় জড়িত ছিলেন আগা সাদেক এবং আগা বাখের। আগা বাখের ছিলেন বাখরগঞ্জের জমিদার এবং তার পুত্র আগা সাদেক। হোসেন উদ্দিন খানের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগা সাদেক মুর্শিদাবাদে হোসেন কুলী খান কর্তৃক বন্দী হন।

সেখান থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসে তিনি হোসেন কুলী খানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। অত্যন্ত সৎ এবং ধার্মিক হোসেন কুলী খানকে রাতের আঁধারে তার প্রাসাদে প্রবেশ করে হত্যা করা হয়। সকাল বেলা ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে শহরের অধিবাসীগণ একত্রিত হয়ে মারমুখী হয়ে ওঠে এবং আগা বাখের ও তদীয় পুত্রকে আক্রমণ করে। তারা নায়েব নাজিমের পদে নিয়োগের বিষয় বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করলে লোকেরা নায়েব নাজিম পদে নিয়োগের সনদ প্রদর্শনের দাবি করে সেই দাবি অমান্য করে করে তারা তরবারি ধারণ করে। এ অবস্থায় জনতার আক্রমণে আগা বাখের প্রাণ হারায় এবং আগা সাদেক মারাত্মকভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও পলায়ন করতে সক্ষম হয়।

নোয়াজেশের পরমবন্ধু ছিলেন হোসেন কুলি খাঁ ও রাজবল্লভ। হোসেন কুলি খাঁ ছিলেন নোয়াজেশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে। তার হত্যাকান্ডে রাজবল্লভ কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন। তখন তিনি অন্য ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করেন। নোয়াজেশ নিঃসন্তান ছিলেন বলে তিনি সিরাজের ছোটভাই মির্জা মেহেদীকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন। মির্জা মেহেদী নোয়াজেশের জীবদ্দশাতেই মারা যান। কিন্তু তার অল্পবয়স্ক পুত্র সন্তান ছিল। রাজবল্লভ তাকেই সিংহাসনে বসিয়ে ঘসেটি বেগমের নামে স্বয়ং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি করার স্বপ্ন দেখছিলেন। এইরকম দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেই আলিবর্দি খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

চারদিকে শুরু হয় প্রচন্ড অরাজকতা এবং ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় দুর্গ সংস্কার করা শুরু করে। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠান। এ রকম পরিস্থিতিতেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর (সিরাজ-উদ-দৌলা) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার প্রাথমিক কার্যাবলি

নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল। নানা নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুতে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে মসনদে বসেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নবাব দেখেন চারিদিকে দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্ত।

নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার প্রাথমিক কার্যাবলিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো
  • মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার ও কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ
  • কলকাতা আক্রমণ
  • নবাবগঞ্জের যুদ্ধ
  • কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া
 
মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার ও কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধঃ সিরাজ-উদ-দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন থেকেই কলকাতায় ইংরেজদের প্রতাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তিনি তাদেরকে দমন করার জন্য কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আদেশ অমান্য করে তারা কাজ বহাল রাখলেন। সিরাজ-উদ-দৌলা তখন বুঝতে পারলেন গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে।

সুতরাং প্রথমেই ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মতিঝিল অধিকার করে নবাব কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ মে তার সেনাবাহিনী কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ করেন। তিনি কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে দরবারে হাজির হয়ে তার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বলেন। ওয়াটসন এই অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য হন।

কলকাতা আক্রমণঃ একই বছর ১৮ জুন সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দুর্গ সিরাজের দখলে আসে। তিনি দুর্গ প্রবেশ করে এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১২ জুলাই তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

নবাবগঞ্জের যুদ্ধঃ দিল্লীর বাদশা পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি সনদ পাঠালেন। শওকত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেন। ইংরেজরা এই সংবাদ পেয়ে গোপনে শওকত জঙ্গের সাথে মিত্রতার করার চেষ্টা করতে থাকে। অপরদিকে মাদ্রাজের ইংরেজ দরবার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠায়। সিরাজ-উদ-দৌলাও শওকত জঙ্গকে প্রতিরোধ করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয়পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে শওকত নিহত হন। সিরাজ-উদ-দৌলা মোহনলালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

ক্লাইভ ও ওয়াটসন পলতায় পৌঁছেই কলকাতা অভিমুখে রওনা হন। প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা দুর্গ জয় করে নেন। এর আগে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায় এসে সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সিরাজ-উদ-দৌলা তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমণ করে। সিরাজ-উদ-দৌলা তার মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং এ কারণে ইংরেজদের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন।

তাই ইংরেজদের সকল দাবিতে রাজি হয়ে তিনি ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সন্ধি 'আলিনগরের সন্ধি' নামে পরিচিত। কিন্তু ইংরেজরা তাদের মতিগতির কোন পরিবর্তন করল না। মূলতঃ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ফরাসিদের সঙ্গে। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। আলিনগরের (কলকাতা) সন্ধির প্রতিশ্রুতি পালনে নবাবকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল।

কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়াঃ সব ধরনের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর সিরাজ-উদ-দৌলা সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে গেলেন। স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে তারা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্ত শুরু করলেন।

ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা খুব শীঘ্রই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এরপর তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছালেন। আর নবাবকে পত্র লিখলেনঃ

আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশীতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন? 

সিরাজদ্দৌলা সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি উঠিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছামাত্রই স্ক্রাফটন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপন সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক গোপন থাকলো না। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার ব্যবস্থা নিলেন। ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেলেন।

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ অনেক তবে মূল কারণ তার সাথে সাধারণ জনগণের দূরত্ব। ইউরোপের দেশগুলোতে রাজারা তাদের দেশের জনগণর মধ্য থেকে সৈন্য রিক্রুটিং করত, তাদের সাধারণ জনগণেরও বিভিন্ন সময় রাজার ডাকে সাড়া দেওয়ার এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অভ্যাস ছিল, কিন্তু আমাদের দেশে এরকম কিছুই ছিল না।

সিরাজউদ্দৌলা তার দেশের সাধারণ মানুষকে কোনো প্রকার ডাকাডাকি করেননি, তারাও তার পক্ষে কোনো প্রকার যুদ্ধ করেনি।দেশের কিছু লোকই শুধু যুদ্ধ বিগ্রহে পারদর্শী ছিল যাদের বেশিরভাগই বিদেশি বংশদ্ভূত, সিরাজুদ্দৌলার নিজের বংশ ইরাক থেকে এসেছিল এবং তারা ছিল শিয়া।

তবে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ বা প্রাথমিক কারণ হলো মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও বৃষ্টির কারণে বারুদ ভিজে যাওয়া। এর পরেও বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা যেত তবে তা হয়নি। নবাবের পরাজয়ের একটি প্রধান কারণ ছিল সিরাজউদদৌলার অন্যতম সেনাপতি মীরজাফরের নেতৃত্বে তার বাহিনী কখনো যুদ্ধ করেনি।

বাংলার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের নাম পলাশীর যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এ যুদ্ধ সংঘটিত হলে নবাব সিরাজউদদৌলা ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন এবং নিহত হন। যার ফলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। অবশ্য নবাবের এ যুদ্ধ নানা কারণে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। নিচে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ গুলো তুলে ধরা হলোঃ-

মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতাঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ হলো মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতা। মীর জাফর ছিলেন নবাবের প্রধান সেনাপতি এবং অধিকাংশ সৈন্য তার অধীনে ছিল। তিনি ইংরেজদের সাথে চুক্তি করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং বিজয় মুহূর্তে নবাবকে যুদ্ধ বন্ধের পরামর্শ দেন। সেই সুযোগে ইংরেজ বাহিনী হামলা চালালে নবাব পরাজিত হন।

সিরাজের অনভিজ্ঞতা ও দৃঢ়চিত্তের অভাবঃ নবাব সিরাজউদ্দৌলা খুব অল্প বয়সে সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন বলে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের তেমন সুযোগ পাননি। অপর দিকে তার সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেও মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির পদে বহাল রেখেছিলেন। এটি ছিল তার দৃঢ়চিত্তের অভাব। ফলে পলাশির প্রান্তরে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল।

অর্থনৈতিক কারণঃ অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে সিরাজকে প্রায়শই জগৎশেঠের মতো বিত্তবান লোকদের দারস্থ হতে হত। এ কারণে এসব ব্যক্তির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যাবলি সম্বন্ধে অবহিত থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগ ছিলেন।

নৌ-শক্তির অভাবঃ ইংরেজদের শক্তিশালী নৌ-বহর নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। অন্যদিকে নবাবের অনুরূপ কোনো নৌ-বহর ছিল না। ফলে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হন। ফলস্বরুপ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ হয়ে দাড়ায়।

বাংলায় চরিত্র সংকটঃ সে সময়ে বাংলায় নিদারুণ চরিত্র সংকট দেখা দেয়। সংকীর্ণ স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা অনেক বাঙালি চরিত্রকে কলুষিত করেছিল। কর্মচারী, সভাসদ, সেনাপতিও সাধারণ সৈন্যরাও জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছিল। ফলে ইংরেজ অনেককে বশে এনে জয় লাভ করে।

লর্ড ক্লাইভের চাতুর্য ও কূটকৌশলঃ নবাব সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক লর্ড ক্লাইভ ছিলেন রণনীতি ও কূটনীতিতে নবাব অপেক্ষা অনেক বেশি সিদ্ধ হস্ত। তারই চাতুর্য ও কূটকৌশল ইংরেজদের সাফল্যের পথ যেমন সুগম করে, তেমনি নবাবের পরাজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

ষড়যন্ত্রঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ গুলোর মধ্যে আরও একটি কারন, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। জগৎ শেঠ, মীরজাফর, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ বা আমির চন্দ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমের প্রভৃতি নিকটাত্মীয় এবং অভিজাত শ্রেণীর ষড়যন্ত্রে সিরাজউদ্দৌলা খুবই দুর্বল অবস্থানে ছিলেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করায়, এবং মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনস্থ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকায় সিরাজউদ্দৌলা খুবই দুর্বল অবস্থানে পতিত হন।

যুদ্ধের উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়াঃ যুদ্ধের সময়ে বৃষ্টিতে নবাব এবং নবাবের সহযোগী ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়।

কুপরামর্শ এবং সিরাজউদ্দৌলার সরলতাঃ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গোলার আঘাতে গুরুত্বপূর্ণ যোদ্ধা মীরমদন নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীর জাফরের কাছে পরামর্শ চান। মীরজাফর নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন। বিশ্বস্ত সেনা মোহনলালের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধ বন্ধ করেন। নবাবের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। মীরজাফরের বার্তা পেয়ে ইংরেজরা নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে।

বিশ্বাসঘাতকতা ও লোভঃ ধর্মগ্রন্থ শপথ গ্রহণ করা সত্বেও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীরজাফরের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে। মীরজাফরকে আগেই নবাব বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইংরেজরা। মীরজাফর এড়াতে পারেনি। এবং বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যক্ষ ফলেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে।

পলাশীর যুদ্ধ কোথায়  সংঘটিত হয়েছিল

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ও ফরাসি মিত্রদের সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৭৫৭ সালের জুন ২৩ তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। এই যুদ্ধ ভারতে ইংরেজ শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শন ও প্রবেশ কে সূচিত করেছিল।

যুদ্ধটি কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে এবং মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে, তৎকালীন বাংলার রাজধানী, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়, হুগলী নদীর তীরে পলাশীতে সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধকারীরা ছিল নবাব সিরাজউদদৌলাহ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তিনি আলীবর্দি খানের স্থলাভিষিক্ত হন।

সিরাজউদদৌলা আগের বছর বাংলার নবাব হয়েছিলেন, এবং তিনি ইংরেজদের তাদের দুর্গের সম্প্রসারণ বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ নবাবের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দেন ও তাকে পরবর্তী নবাব করার প্রতিশ্রুতি দেন। লর্ড ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলাকে পরাজিত করেন এবং কলকাতা দখল করেন।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন কেন 

পলাশীর যুদ্ধ কোন যুদ্ধই ছিল না। কারণ এটা ছিল প্রহসনের যুদ্ধ, যুদ্ধযুদ্ধ খেলা মাত্র। আসলে সিরাজ যাদেরকে বিশ্বাস করতেন উমিচাঁদ, সেনাপতি রায় দুর্লভ , প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আর বঙ্গের শ্রেষ্ঠ ধনী জগতশেঠ, এঁরাই ছিল সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী। মীরজাফর পবিত্র কুরআন শরীফ ছুয়ে আর উমিচাঁদ,মানিক চাঁদ, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ছুয়ে শপথ করে যে তারা সিরাজের অনুগত হয়ে থাকবে।

সিরাজও তাদের এই শপথকে শেষমুহুর্ত পর্যন্ত অবিশ্বাস করেননি। শত্রু প্রকাশ্য হলে এর দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধু শত্রু হলে ফল হয় আরও মারাত্মক। পলাশীর যুদ্ধে এ সত্যিই দারুণভাবে প্রমাণিত। আমরা যুদ্ধের আগে ষড়যন্ত্রের সময়ে ফিরে যাই তাহলে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

সিরাজের সিংহাসনে বসার পরেই নবাবকে অযােগ্য মনে করে ইংরেজরা। দুঃসাহসের সাথে কলকাতার ঘাটি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। সিরাজ সাথে সাথে সংবাদ পাঠালেন দুর্গ তৈরি বন্ধ করা ও তা ভেঙ্গে ফেলা নবাবের আদেশ। ইংরেজরা নবাবের আদেশ অগ্রাহ্য করে দুর্গ তৈরির কাজ অব্যাহত রাখে। এক কথায় নবাবের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য তারা আগে থেকেই তৈরি ছিল। সিরাজ পূর্ণ সাহিসিকতার সাথে আক্রমণ করে এবং তাদেরকে ভীষণভাবে পরাজিত করেন।

সিরাজের কলকাতা অধিকারের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছালে সাথে সাথে বৃটিশ সেনাপতি ক্লাইভ বিরাট সৈন্য সামন্ত নিয়ে কলকাতা পুনর্দখল করেন। সিরাজ কলকাতার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মানিক চাদের উপর, সে বিনাযুদ্ধেে কলকাতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। সিরাজ আবার অভিযান করতে চাইলেন কিন্তু তার ঘনিষ্টজন বুঝিয়ে তাকে সন্ধিতে রাজি করায়। তিনি দেখলেন ইংরেজদের চক্রান্তে তার বিশ্বাস ভাজন হিন্দু ও মুসলমান বন্ধু বান্ধব ও ইংরেজকে জয়ী করার জন্য সর্বস্ব পণ করে লেগেছেন, 

ফলে বাধ্য হয়েই তাকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে সন্ধি করতে হয়। এ সন্ধির নাম হয় আলী নগরীর সন্ধি। সন্ধির শর্তানুযায়ী কলকাতা ইংরেজরা ফিরে পায় এবং শুধু ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেরামত বা নির্মাণের অধিকার প্রাপ্ত হয়। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে ইংরেজরাই বিশ্বাসঘাতকের ভুমিকায় হঠাৎ বঙ্গের চন্দন নগর দখল করে এবং সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।

পরে ইংরেজরা একটা বড় অস্ত্র হাতে পেয়েছিল। বঙ্গের বিখ্যাত জগৎশেঠ ও কলকাতার বড় বড় ব্যবসায়ী উমিচাদ, রাজবল্লভ প্রমুখ দেশের শক্রু ও শোষকবৃন্দ সেসময় সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে যােগ দেন।

জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন সভা হয়। সে গোপন আলােচনায় স্ত্রীলােকের ছদ্মবেশে ইংরেজের দুত মিঃ ওয়াটসকে পাল্কিতে করে আনা হয়। এ সভায় মিঃ ওয়াটস প্রচুর লোভ লালসা দেখিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে এবং মুসলমানদের উত্তেজিত হয়ে ওঠার রাস্তা বন্ধ করতে তারই আত্নীয় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানাে হবে।

মিঃ ওয়াটস আরও জানায়, সিরাজের সাথে লড়তে যে প্রস্তুতির প্রয়ােজন এবং এর জন্য যে প্রচুর অর্থের আবশ্যক তা বর্তমানে আমাদের নেই। জগৎশেঠ সে কর্তব্য পালন করতে সদম্ভে আশ্বাস দিয়েছিলেন, টাকা যা দিয়েছি আরও যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাব, এতে কোন চিন্তা নেই। 

এবার রাজবল্লভ সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমকে বোঝালেন - আমরা চেয়েছিলাম আপনি সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু এখনো উপায় আছে যদি আপনি আমাদের অর্থাৎ ইংরেজদের একটু সমর্থন দান করেন মাত্র। 

মীরজাফরকে এটি বােঝাতে বেগ পেতে হল। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, আমি নবাব ,আলিবর্দীর শ্যালক অতএব সিরাজউদদৌল্লা আমার আত্নীয়, কি করে তা সম্ভব? তখন উমিচাঁদ বুঝিয়েছিলেন, আমরাতো আর সিরাজকে মেরে ফেলছিনা অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না , শুধু তাকে সিংহাসনচ্যত করে আপনাকে বসাতে চাইছি । কারণ আপনাকে শুধু আমি নই এবং ইংরেজরা এবং মুসলমানদের অনেকেই আর অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সতরাং মীরজাফর উমিচাঁদের বিষপান করলেন।

যাহোক, যড়যন্ত্রের জাল বােনা যখন শেষ , ভারতের স্বাধীনতা সুর্যকে পরাধীনতার গ্লানিতে কবর দেয়ার সমস্ত পরিকল্পনা যখন প্রস্তুত সে সময় ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ১৩ জুন ক্লাইভ মাত্র ৩২০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করেন। ১৯ জুন নবাবের অধীনস্থ কাটোয়া ক্লাইভের দখলে আসে। ২২ জুন গঙ্গা পার হয়ে ক্লাইভ মধ্য রাত্রে নদীয়া জেলার সীমান্তে পলাশীর প্রান্তরে পৌছেন। নবাবের প্রচুর সুদক্ষ সেনা প্রথম থেকেই তৈরি ছিল। ক্লাইভের তবুও ভয় নেই , কারণ তিনি জানেন। এ যুদ্ধ যুদ্ধ নয় পুতুল খেলার শামিল। আগে থেকেই পরিকল্পনা পাকাপাকি। উমিচাঁদ, বায়দুর্লভ , জগৎশেঠ, ইংরেজ প্রমুখের সাজানাে সেনাপতি আজ ভিতরে ভিতরে ক্লাইভের স্বপক্ষে।

ক্লাইভের সৈন্য যেখানে মাত্র ৩২০০ সেখানে সিরাজের সৈন্য ৫০,০০০, ইংরেজরা হালকা কামান নিয়ে যুদ্ধে আসে আর সিরাজের ছিল শক্তিশালী ভারী কামান। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও অন্যান্য সেনাপতি পুতুলের মত দাঁড়িয় থাকল আর ইংরেজদের আক্রমণ ও গুলির আঘাতে নবাবের সৈন্য আত্মহত্যার মত মরতে শুরু করল। এ অবস্থায় মীরজাফরের বিনা অনুমতিতেই সিরাজের জন্য তথা দেশ ও দশের জন্য মীর মর্দান ভয়াবহ বীরবিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করে আর পরুক্ষনেই গুলিতে বীরের মত শহীদ হলেন। 

নবাব সিরাজ এ সংবাদে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। এ সময় যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকুলে যাচ্ছিল। কারণ মীর মর্দানের বীরত্বে মােহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি স্যাঁফ্রে তখন ইংরেজদের কায়দা করে ফেলে ছিলেন। এমন শুভ মুহূর্তে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধ করতে আদেশ দেন। এদিকে ক্লাইভ এ মুহুর্তটির অপেক্ষাতেই ছিল। নীরবে মুসলমান ও হিন্দু সৈন্যদের উপর গােলাবর্ষন চলতে লাগলো। অবশেষে নিরুপায় নবাবের সৈনারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। নবাবও রাজমহলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে গিয়ে ধরা পড়লেন এবং তাকে বন্দি করা হল। শেষে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ।

এরপর সিরাজকে হত্যা করে তার মৃতদেহকে একটি বস্তায় ভরে হাতির পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিরাজের স্ত্রী , মা এবং অনেক আত্মীয়া তখন বন্দিনী । তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তারা আলিবর্দীর বিখ্যাত বাগানের আম খেতে চান কি-না। অশ্রু সজল নয়নে তাঁরা ইঙ্গিতে সম্মতিই দিয়েছিলেন।

এরপর করুণার জীবন্ত ছবি, ইংরেজ কর্মচারীর আদেশ অনুযায়ী অর্ধ ভর্তি আমের বস্তা পৌছে দেয়া হয়েছিল এবং নবাব পরিবারের সমস্ত মহিলাদের পক্ষ থেকে একজন বস্তার মুখ খুলতেই দেখতে পেলেন ভিতরে আমও নেই বা অন্য কোন খাদ্যবস্তুও নেই , আছে সি বীভৎস কাঁচা কাটা মাথা। সিরাজ যেন তার গর্ভধারিণী মাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছেন। সিরাজের হতভাগী মা প্রিয় পুত্রের মুখের দিকে এক পলক তাকাতেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সম্বিত ফিরে এলে মীর জাফরের অনুচর গােলাম হােসেনের আদেশে তাকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয়।

এদিকে জয়নুল আবেদীন নামক এক দরিদ্র নাগরিকের অনুরােধে সিরাজের খন্ডিত দেহকে ভাগীরথী নদীর পাড়ে খােসবাগ নামক বাগানে নানাজান আলিবর্দীর কবরে পূর্ব পাশে সমাহিত করা হল।

পলাশি যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

সিরাজউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোনো উপঢোকন পাঠায়নি এবং তাঁর সঙ্গে কোনো সৌজন্যেমুলক সাক্ষ্যৎও করেনি। ইংরেজদের এই অসৌজন্যমূলক আচরণে নবাব ক্ষুব্ধ হন। নীচে পলাশি যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করা হলো-

পলাশির যুদ্ধের কারণ:
  • নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইংরেজদের কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ।
  • নবাব দস্তকের অপব্যবহার নিষেধ করা সত্ত্বেও কোম্পানি নবাবের আদেশ অগ্রাহ্য করা।
  • কোম্পানি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করা ও জনগণের উপর ইংরেজদের নির্যাতন।
  • ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও অবাধ্যতা।
  • নবাব কর্তৃক ব্রিটিশদের দেওয়া বাণিজ্য সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহার।
  • ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্রমিকদের কর ও শুল্ক পরিশোধ না করা
  • ব্রিটিশদের দ্বারা নবাবকে বিভিন্ন ফ্রন্টে বিভ্রান্ত করা।
  • কৃষ্ণদাস কে কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় দেওয়া।
  • দুর্নীতি পরায়ন কর্মচারিরা গোপনে ব্রিটিশ শিবিরে আশ্রয়ে যাওয়া
পলাশির যুদ্ধের ফলাফলঃ
  • বাংলায় প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম করে।
  • মীরজাফর বাংলার নবাব হিসাবে মুকুট লাভ করেন।
  • পলাশীর যুদ্ধের ফলে ফরাসি বাহিনীর অবসান ঘটে। ফরাসীরা এদেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
  • ইংরেজরা মীর কাসিমকে বাংলার নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসায়।
  • ইংরেজরা বাংলায় ইউরোপীয় শক্তিতে পরিণত হয়।
  • রবার্ট ক্লাইভকে লর্ড ক্লাইভ উপাধি দেওয়া হয়।
  • ভারতের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • ব্রিটিশরা কর আদায়ের নামে বাংলার অধিবাসীদের ওপর কঠোর নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিতে থাকে।
  • যুদ্ধের ফলে মীরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসালেও তিনি ছিলেন নামে মাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল রবার্ট ক্লাইভের হাতে।
  • পলাশী যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে।
  • এ যুদ্ধের পর ইংরেজ শক্তির স্বার্থে এদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে।
  • পলাশী যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি ছিল সমগ্র উপমহাদেশে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা। এভাবেই এ যুদ্ধের ফলে বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতা ভু-লুণ্ঠিত হয়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী কে

সিরাজউদ্দৌলা হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই ছিল সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন। মোহাম্মদী বেগ ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁর পৌষ্য। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় সে বেড়ে উঠে। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিল এই মোহাম্মদী বেগ, যাকে আলীবর্দী খাঁ কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন।

মোহাম্মদী বেগ একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩’রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চান নাই। তিনি কেবল তার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য কুখ্যাত মোহাম্মদী বেগ সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিল। মোহাম্মদী বেগ তার সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ অবস্থায় এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এভাবেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব 

বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেন। একটি পর্যায়ে ইংরেজরা নবাবকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হয়। সিরাজও তার বাহিনী নিয়ে পলাশীর পথে অগ্রসর হন। ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় নবাবের বাহিনীর আকার অনেক বড় হলেও মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনস্থ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে।

মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নবে সিং হাজারীর নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা এবং ফরাসী সৈনিকদের একটি দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ক্লাইভ যুদ্ধে ধারণার চেয়ে বেশি প্রতিরোধের সন্মুখীন হন। যুদ্ধ চলাকালে বৃষ্টিতে নবাব এবং ফরাসীদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ক্লাইভ দিনে যুদ্ধ চালিয়ে রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলার আঘাতে মীরমদন নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীর জাফরের কাছে পরামর্শ চান।
 
মীরজাফর নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন। মোহনলালের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও নবাব যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। নবাবের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। মীরজাফরের বার্তা পেয়ে ইংরেজরা নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। প্রতি বছর সে জন্য ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৭৫৭ সালের এইদিনে পলাশী প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চক্র এই কালো দিবসের জন্ম দেয়। ঘৃণিত কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, নন্দকুমার প্রমুখ কৌশলী চক্র।

এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের প্রথম শিকার ছিল স্বাধীন ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন ও প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে এক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়। এতে নবাব বাহিনীর পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

ফলে যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে এভাবেই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন শোষণ করে। কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে। 

এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। বাংলা অধিকারের পর ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য অংশও নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। পলাশীর যুদ্ধের এই নৃশংস ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কলকাতা কেন্দ্রিক একটি নতুন উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। ইংরেজ ও তাদের এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে।

পলাশীর যুদ্ধের বিবরণ

১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।

বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।

২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানটির উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন।

ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন ও মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন।

গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তার নির্দেশ অমান্য করেন। তাদের যুক্তি ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েকশত গজ। বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধবিরতি ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সিরাজ মীর জাফর প্রমুখের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন।

বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপীয় এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। তখন কোনো উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য ২,০০০ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি।

সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের হাতে বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।

সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে কেমন ছিলেন

নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার শাসনের প্রথম কয়েকমাস তিনি তার শৌর্য ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে অপরিপক্ক কম বয়সি ছিলেন। রাজনৈতিক বুদ্ধি তেমন ছিলোনা, নিজ অভিজাতদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। একবার মীরজাফরের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে, জগৎশেঠ কে চড় মেরেছিলেন। এছাড়াও অল্পবয়েস থেকেই সিরাজ নানা অমিতাচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। নারীঘটিত ব্যাপার তো ছিলোই, বিভিন্ন ধরণের নেশাভাঙ ও ছিলো।

জনশ্রুতি আছে, নোয়াজেস মোহাম্মদের ডেপুটি হোসেন কুলি খানের সাথে ঘসেটি বেগম ও সিরাজের মা আমিনা বেগমের অবৈধ সম্পর্ক ছিলো কিন্তু এর তেমন কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সিরাজ হোসেন কুলি কে হত্যা করেন। শোনা যায় অলিবর্দীর স্ত্রী র মারফত আলীবর্দী কে ও এই হত্যার হুকুমে সিলমোহর দেওয়ানো হয় কিন্তু এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী , হোসেন কুলি র প্রতি অনেক অভিজাত ই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তারাও সিরাজের বিপক্ষে যান। সিরাজের কলকাতা আক্রমণ ও ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। কোম্পানি হয়তো বা বাংলা তথা ভারত অধিকারের দিকে যেত ই না কিন্তু অন্ধকূপ হত্যা তাদের প্রতিশোধস্পৃহা বাড়িয়ে তোলে। এর ই ফলস্বরূপ পলাশীর যুদ্ধ। বাকিটা তো সবাই জানেন।

সিরাজ শেষের দিকে তার ভুলগুলি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি যখন পলায়ন করছেন তখনও আরো একটু দ্রুতগামী হলে হয়তো বিরুদ্ধপক্ষ হেরে যেত কারণ তখন বিহারের নায়েব রামনারায়ন সিরাজের পক্ষে ছিলেন। ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে ল ও সিরাজ কে বাঁচাতে এগিয়ে আসছিলেন। কোনোভাবে এদের কাছে পৌঁছতে পারলে এদের সেনাবাহিনী ইংরেজ মীরজাফর ও জগৎশেঠের মিলিত বাহিনী কে হারিয়েও দিতে পারতো কিন্তু সিরাজ আবার ভুল করেন , দানা শা ফকিরের ডেরায় আশ্রয় নিতে যান। কথিত আছে এই দানা শা কে ও আগে একবার সিরাজ অপমানিত করেছিলেন।

শোনা যায় সিরাজ তার মৃত্যুর আগে হোসেন কুলিকে বধ করার জন্যে আক্ষেপ ও করেছিলেন। মোহম্মদি বেগ যখন তাকে হত্যা করতে এসে তখন নাকি এও বলেছিলেন যে অল্প একটু জমি নিয়ে তিনি বাকি জীবন কাটাবেন। রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকবেন কিন্তু সেই আবেদন শোনা হয়নি। আমার মনে হয় মীরজাফর ও সিরাজ দুজনের কেউ ই খুব খারাপ লোক ছিলেন না। সিরাজ যখন মীরজাফরের কাছে প্রাণভিক্ষা চান, মীরজাফর সেই আর্জি মনজুর ও করেন কিন্তু তার ছেলে মিরণ ছিলো সাক্ষাৎ শয়তান, মূলত তার নির্দেশেই সিরাজ কে হত্যা করা হয়।

আরো একজন শয়তান ছিলেন , তিনি হলেন মিরকাশিম। অনেক ঐতিহাসিক তাকে হিরো বানানোর চেষ্টা করেন, তিনি নাকি দেশপ্রেমিক ছিলেন। একদম ভুল। তিনি তার শশুর মীরজাফর কে হত্যার ও চেষ্টা করেন কিন্তু ইংরেজ রা রাজি হয়নি। ইংরেজ দের প্রচুর ঘুষ দিয়ে উনি নবাব হন, এবং সিরাজ ও লুৎফাননুসা কে আটক করার সময় তাদের একটি গুপ্ত গয়নার বাক্স লুট করে ই তিনি এত টাকা পয়সা পান বলে শোনা যায়।

এরপর প্রজাদের সাংঘাতিক শোষণ শুরু করেন মিরকাশিম এবং তারপর ইংরেজ দের সাথে যুদ্ধে হারার পর জগৎশেঠ , রামনারায়ন প্রভিতিকে অন্যায়ভাবে মেরে ফেলেন। তার সেনাপতি গুরগিন খাঁ ওরফে খোজা গ্রেগরিকেও নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। এরপর তার অন্যান্য সেনাপতি সমরু মার্কার এবং এরাতুনকে দিয়ে তার কুখ্যাত great patna massacre সংঘটিত করান। পাটনার ভারপ্রাপ্ত ইংরেজ অফিসার এলিস , তার নাবালক ছেলে এবং মিস্টার হে, লুসিংটন সহ প্রায় ৪৫ জন ইংরেজ কে বন্দি অবস্থায় মেরে ফেলেন।

শুধু ফুলার্টন কে মারেন নি, তিনি মিরকাশিমের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন বলে। আর এই হত্যাকাণ্ডের ফলেই ইংরেজ রা বদ্ধপরিকর হয় ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে, নইলে তাদের নিজেদের মধ্যেও বহু ঝামেলা ছিল। কলকাতা কাউন্সিলে মিটিং চলাকালীন হেস্টিংস ও ব্যাটসনের মধ্যে একবার তো মারামারি ও হয়। কাজেই পক্ষান্তরে মিরকাশিম ই ইংরেজ রাজত্বের বীজ বপন করে গেছিলেন। সিরাজ বা মীরজাফর অত খারাপ ও ছিলেন না।

১৭৫৭ সালে প্রতারিত না হলে কি নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধ জিততে পারতেন

অবশ্যই জিততে পারতেন, পানি খাওয়ার মত সহজে। সিরাজের ছিল ৫০,০০০ সৈন্য ও ৫০ টি ভারী কামান আর ইংরেজদের ছিল ৩২০০ সৈন্য ও ৮ টি হালকা কামান। পলাশীর যুদ্ধ ছিল প্রহসনের যুদ্ধ। সিরাজ তার সৈন্যবাহিনীর ৪ ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করলেও খুব সহজেই পলাশীর যুদ্ধে জিততে পারতেন। কিন্তু পলাশীতে কোন যুদ্ধ হয় নি, হয়েছে পাতানো যুদ্ধের মহড়া।
১৭৫৭-সালে-প্রতারিত-না-হলে-কি-নবাব-সিরাজউদ্দৌলা-পলাশীর-যুদ্ধ-জিততে-পারতেন
আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন আর তারপরই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শুরু। আওরঙ্গজেব এর মৃত্যু হয় ১৭০৭ সালে, তারপর ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান শুরু হয়। এমনকি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরেও মারাঠা সাম্রাজ্য আয়তনে বাড়তেই থাকে। ১৭৬০ সালে বর্তমান ভারতের প্রায় ৭৫% ছিল মারাঠাদের দখলে।

সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন সুবে বাংলার (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) শেষ স্বাধীন নবাব। আলীবর্দী খাঁ ১৭৪০ সালে সুবে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। তার পরের বছর থেকেই বাংলায় শুরু হয় বর্গী (মারাঠা সাম্রাজ্যের ভাড়াটে সৈন্য) দের উৎপাত।

সেই ছড়াটা মনে আছে

খোকা ঘুমালো
পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে

তারপর প্রায় ১০ বছর যুদ্ধ করার পর, ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সাথে আলীবর্দী খাঁর সন্ধি হয়। আর সন্ধির শর্ত অনুযায়ী উড়িষ্যা চলে যায় মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীনে। মির জাফরকে সিরাজ উদ দৌলা খুব বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও মির জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে।

১৭৫২ সালে যখন আলীবর্দী নাতি সিরাজ কে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন তখন থেকেই ঘসেটি বেগম, সৌকাত জঙ্গ আর মির জাফর ভেতরে ভেতরে তার বিরোধিতা শুরু করে। তাই ১৭৫৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরই সিরাজ ঘসেটি বেগমকে বন্ধি করলেন, মির জাফর এর জায়গায় মির মদনকে বকশি হিসাবে নিয়োগ করলেন আর সৌকাত জঙ্গকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করলেন।

এই বার মূল প্রশ্নের উত্তরে আসি, আমার মনে হয় মির জাফর, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ’রা ইংরেজ বাহিনীকে সাহায্যের আশ্বাস না দিলে হয়ত পলাশীর যুদ্ধটাই হতো না।

আর পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ জিতলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তল্পি তল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে যেতো, এমনটাও মনে হয় হতো না। আসলে সিরাজ শাসক হিসেবে খুব একটা উঁচু দরের ছিলেন না। তাই তার বিরোধী গোষ্ঠীরা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছিল। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিল ইংরেজরা।

সিরাজের থেকে ধারে ও ভারে বহুগুণ শক্তিশালী মারাঠাদের সাথেও ইংরেজরা একই কৌশলে যুদ্ধ শুরু করে। তারপর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্যকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রাস করে নেয়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার কয়টা প্রাসাদ ছিলো

নবাব সিরাউদ্দৌলার সময়ে ঢাকা এলাকায় একাধিক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদগুলি নবাব সিরাউদ্দৌলার সাম্রাজ্যের একাধিক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানে অবস্থিত ছিল, এবং এগুলি বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্যের সাথে জড়িত ছিল। তার কয়েকটি প্রাসাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি যা নিম্নলিখিত

হীরাঝিল প্রাসাদঃ এটি সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাসাদ ছিলো। এটি মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত। এই প্রাসাদটি ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলে আসে। বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সংরক্ষিত আছে।এটি এখন একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম হীরাঝিল প্রাসাদ। তবে ভাগীরথীর ভাঙ্গনে প্রসাদটি বীলিনের দিকে প্রায়।

ফৌজবাহাদুর প্রাসাদঃ
এটি মুর্শিদাবাদে অবস্থিত একটি প্রাসাদ। এটি ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদটি বর্তমানে একটি সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

আলামগীর কল্লা (Lalbagh Fort):এটি রাজধানী ঢাকা বুড়ীগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত একটি কম্প্লেক্স, যেখানে মকবারা, মসজিদ, ঔপনিবেশিক প্রাসাদ।

চৌখানা (Chowk Bazaar): এটি প্রাসাদ ঢাকার চৌখানা এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং নবাবের অস্ত্র এবং আর্মারি স্টোরের জন্য ব্যবহৃত হতো।

শাহের কুলি (Shahi Qila): এটি মোটিজিলের কাছে অবস্থিত একটি প্রাসাদ ছিল, যেখানে নবাবের কর্তব্য প্রাপ্ত করার জন্য এবং দরবারের জন্য ব্যবহৃত হতো।

পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার নবাব কে ছিলেন

আপনি কি জানেন পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার নবাব কে ছিলেন? অনেকেই হয়তো জানেন না যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার নবাব কে ছিলেন। মীরজাফর নবাব হওয়ার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে 'রাজস্ব ইউনিট' দিয়েছিলেন। প্রশাসনের এই ব্যবস্থা শের শাহ সুরি বা সুরি সাম্রাজ্য দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। মুঘল শাসনামলে, চব্বিশ পরগণার অঞ্চল সাতগাঁও (প্রাচীন ও মধ্যযুগে কিছু সময়ের জন্য দক্ষিণ বাংলার রাজধানী ছিল একটি প্রধান বন্দর) প্রশাসনের অধীনে ছিল।

মুঘল শাসনের অবসানের পর, প্রশাসন হুগলি চাকলায় স্থানান্তরিত হয়, যেটি মুর্শিদকুলি খানের (বাংলার প্রথম নবাব) অধীনে ছিল। ১৭৫৭ সালে মীরজাফর নবাব হতে চেয়েছিলেন। তিনি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং পলাশীর যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন। যা মীরজাফরকে নবাব হতে দেয়। যেহেতু ব্রিটিশরাই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করেছিল এবং নবাবকে পরাজিত করেছিল, তাই ব্রিটিশরা চব্বিশ পরগণার জমিদারি দাবি করেছিল। তাই, মীরজাফর চব্বিশ পরগণার সমস্ত কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে অর্পণ করেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়, সুন্দরবনের আশেপাশের পরগণার কিছু অংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার একটি অংশ করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে, একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির পরামর্শ অনুসারে 24 পরগনা দুটি জেলায় বিভক্ত। ১লা মার্চ ১৯৮৩ সালে, বিভাগটি কার্যকর করা হয় এবং দুটি জেলা তৈরি করা হয়; উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর

নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর কে বা করা সে সম্পর্কে আমরা হয়তো সঠিক ধারনা রখিনা। তবে যেহেতু সিরাজউদ্দৌলা বাংলার একজন নবাব ছিলেন সেহেতু তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বংশধর ও ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরী। ভাগীরথী থেকে বুড়িগঙ্গা, মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা। রাজকীয় হীরাঝিল প্রাসাদ থেকে ঢাকা শহরের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা।

একদা বাংলা, বিহার, ওড়িশার আকাশ বাতাস কেঁপে উঠতো যাদের হুংকারে। ভাগিরথীর তীরে মুর্শিদাবাদ নগরে আলোকোজ্জ্বল মহল সর্বদা সরগরম থাকতো। যে দাপুটে নবাবের পদচারণায় সুবে বাংলার সেই শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরেরা এখন ঢাকা শহরে বসবাস করছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নীরবে নিভৃতে। অনেকেই তাদের খবর জানে না, অনেকেই খবর নেয় না। নবাব সিরাজউদদৌলা বাঙালি ছিলেন না, তিনি বাংলার ছিলেন না কিন্তু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। ভালবাসতেন বাংলাকে, বাঙালিকে।

আলিবর্দী খাঁ ইরান থেকে এসে ১৭৪০ সালে ৬৬ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। নবাব সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন আলিবার্দি খানের খুবই আদরের নাতি। নবাব সিরাজ উদ দৌলার জন্ম হয় ১৭৩৩ ( মতান্তরে ১৭৩৩ , ১৭২৭ ) খ্রিস্টাব্দে, জুলাই মাসের ২ তারিখ রাজমহলে এবং মৃত্যু হলো ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। কারো মতে জন্ম ১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর।

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয় এবং ২রা জুলাই ঘাতকের হাতে তার প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় বহুকালের জন্য। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

সিরাজের পিতা জাইন উদ্দিন ছিলেন বিহারের নবাব ও আলী ওয়ার্দি খানের বড় ভাই, হাজী আহমেন্দের ছেলে। এবং তার মা, আমিনা বেগম ছিলেন নবাব আলী ওয়ার্দি খানের সর্ব কনিষ্ট মেয়ে। যেহেতু আলী ওয়ার্দি খানের কোনো ছেলে ছিল না, সিরাজ, তার নাতি হিসেবে, তার মনের অনেক কাছে ছিল এবং সিরাজের বাল্যকাল থেকেই, ওকে, মুর্শিদাবাদ এর উত্তরসুরী হিসেবে দেখা হত।

তার অনুসারে, সিরাজকে নবাবের দুর্গে, সকল সুযোগ, সুবিদা এবং শিক্ষা দেওয়া হয়, ভবিষ্যতের নবাব হিসেবে। ১৭৪৬ সালে, বাল্য সিরাজ তার নানা, আলী ওয়ার্দিকে, মিরাথাস্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করে। ১৭৫২ সালে, ১৯ বছর বয়সী সিরাজকে, তার নানা, আলী ওয়ার্দি, তার উত্তরসুরী (আলী ওয়ার্দির রাজ্যের নবাব) হিসেবে ঘোষিত করে এবং তার রক্তের অন্য কাউকে তার কোনো সম্পত্তির মালিক করে নি।

সিরাজউদ্দৌলার প্রকৃত নাম মীর্জা মুহম্মদ আলী। সিরাজ উদ দৌলার আরেক নাম ছিল Sir Roger Dowllet বা সার রজার দৌলেত, কারণ অনেক ইংরেজরা তার নাম উচ্চারণ করতে পারত না।

আমাদের এই ঢাকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা হয়ে আছে নবাব পরিবারের দুর্দিন, দুঃসময়ের জীবন। সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুননিসা, একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরা, নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসা সহ নবাব পরিবারের নারীদের ৮ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা পাড়ের জিঞ্জিরা এলাকার একটি প্রাসাদে। স্থানীয় লোকজন ওই জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে এখনও জানে ‘নাগরা’ নামে। বর্তমানে ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড-এর বৈকালী টাওয়ারে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা।

তাদের একজন সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব। তিনি কাজ করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে। বর্তমানে ড. ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক পলাশী পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ওই বাসাতেই আছেন তার পিতা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা। তিনি নবাব সিরাজউদদৌলার ৮ম বংশধর। তার প্রয়াত স্ত্রী সৈয়দা হোসনেআরা বেগম ছিলেন নবাবের স্ত্রী লুৎফুননিসার রক্তের উত্তরাধিকার। এখানেই বাস করছেন তিনি এবং তার ২ ছেলে গোলাম আব্বাস আরেব ও ইমু এবং ২ কন্যা মাসুমা ও মুনমুন।

নবাব পরিবারের নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেবের পূর্ববর্তী বংশধরের কুষ্ঠি বিশ্লেষণ করে জানা যায়ঃ-
  • নবাব সিরাজউদ্দৌলার মেয়ে উম্মে জোহরা ওরফে কুদসিয়া বেগম (প্রথম বংশধর)
  • জোহরার ছেলে শমসের আলী খান (দ্বিতীয় বংশধর)
  • তাঁর ছেলে লুৎফে আলী (তৃতীয় বংশধর)
  • লুৎফের মেয়ে ফাতেমা বেগম (চতুর্থ বংশধর)
  • তাঁর মেয়ে হাসমত আরা বেগম (পঞ্চম বংশধর)
  • হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকি রেজা (ষষ্ঠ বংশধর)
  • তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম মোর্তজা (সপ্তম বংশধর)
  • গোলাম মোর্তজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তফা (অষ্টম বংশধর)
  • এবং তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব (নবম বংশধর)

কিভাবে তারা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরঃ
নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরদের বংশতালিকার হিসাব দিলেন গোলাম আব্বাস আরেব। ইরান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বাংলায় আসা নবাব আলীবর্দী খানের কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার ছিল ৩ কন্যা। ঘসেটি বেগম, ময়মুনা বেগম ও আমেনা বেগম। আলীবর্দী খানের বড় ভাই হাজী মির্জা আহমেদের ছিল ৩ পুত্র। মুহাম্মদ রেজা, মুহাম্মদ সাঈদ ও মুহাম্মদ জয়েনউদ্দিন। আলীবর্দী খানের ৩ কন্যাকে বিয়ে দেন তার ভাই হাজী আহমেদের ৩ পুত্রের সঙ্গে।

মুহাম্মদ রেজার সঙ্গে বিয়ে দেন ঘসেটি বেগমের। মুহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে ময়মুনা বেগমের এবং আমেনা বেগমের বিয়ে দেন জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। জয়েনউদ্দিন ও আমেনা বেগমের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। তাদের বড় সন্তান নবাব সিরাজউদদৌলা, অপর ২ ছেলে হচ্ছেন ইকরামউদদৌলা ও মির্জা মেহেদি। ২ কন্যা আসমাতুন নেসা ও খায়রুন নেসা।

নবাব সিরাজউদদৌলা বিয়ে করেন ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুননিসাকে। ইরাজ খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মোঘল দরবারের কর্মকর্তা। সিরাজউদদৌলার একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরা বেগম। সিরাজউদদৌলার যখন মৃত্যু হয় তখন উম্মে জহুরা শিশু। সিরাজ কন্যা জহুরা বেগমের বিয়ে হয় সিরাজের ভাই একরামউদদৌলার পুত্র মুরাদউদদৌলার সঙ্গে।

তাদের একমাত্র পুত্র শমসের আলী। তার পুত্র সৈয়দ লুৎফে আলী। তার কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার একমাত্র কন্যা ফাতেমা বেগম। ফাতেমা বেগমের ২ কন্যা হাসমত আরা বেগম ও লুৎফুননিসা বেগম। লুৎফুননিসা নিঃসন্তান। হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকির রেজা। তার ছেলে সৈয়দ গোলাম মর্তুজা। সৈয়দ গোলাম মর্তুজার ছেলে এই সৈয়দ গোলাম মোস্তফা।

২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পর ২৫শে জুন নবাব সিরাজউদদৌলা স্ত্রী লুৎফুননিসা ও শিশুকন্যা জহুরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আবার সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলা উদ্ধার করতে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ভগবানগোলায় ক্ষুধার্ত নবাব পরিবার দানা শাহ নামের এক লোকের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ কালে ওই ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেন নবাব সিরাজউদদৌলাকে। সেখানে গিয়ে মীর জাফরের ছেলে মিরন গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন নবাবকে। বন্দি অবস্থায় ২রা জুলাই মোহাম্মদী বেগ হত্যা করে নবাব তাকে।

নবাবকে হত্যার পর তার স্ত্রী শিশুকন্যা সহ নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন নেসাকে নৌকায় করে ভাগীরথীর তীর থেকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিঞ্জিরার একটি প্রাসাদে তাদের আটকে রাখা হয় ৮ বছর। সেখান থেকে আবার তাদের মুর্শিদাবাদে নিয়ে মুক্ত করা হয়। নবাব সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোন চাকরি দেয়নি বৃটিশ সরকার।

নবাবের ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর কাছে এসে ধরনা দিলে ১৯১৩ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর তিনি বাংলার গভর্নরের নিকট কাছে তাকে একটি চাকরি দেয়ার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় তিনি সিরাজউদদৌলার বংশধর। সে অনুরোধের প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার সৈয়দ জাকি রেজাকে মুর্শিদাবাদের ডেপুটি সাব-রেজিস্টার পদে নিয়োগ দেন। তার পুত্র সৈয়দ গোলাম মর্তুজা চাকরি করতেন মুর্শিদাবাদের কালেক্টরেট বিভাগে।

সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। প্রথমে আসেন রাজশাহীতে, রাজশাহী থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী হন।

১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলে লোহানী তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান (বিটিভি-তে প্রচারিত) 'যদি কিছু মনে না করেন'-এ জনাব ,সৈয়দ গোলাম মুর্তজা-কে পরিচিত করিয়ে দেন । গোলাম মর্তুজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা পাকিস্তান আমলে চাকরি নেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে। তিনি এখন ছেলে সন্তান সহ বসবাস করছেন ঢাকা শহরে।

তার বড় ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব সমাজের গুণীজন, বিত্তবান সহ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা নবাব সিরাজউদদৌলার নামে একটি একাডেমী স্থাপন করতে চান। সে জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে বসবাস করা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে এখনও কি যেন এক ধরনের অজানা আতঙ্ক তাদের মাঝে।

সম্ভবত সে আতঙ্ক থেকেই অন্তর্মুখী প্রচারবিমুখ হয়ে আছেন তারা। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মীর জাফরের বংশধররা স্ব-স্ব পরিচয় দিয়ে দাপটে আছেন। জানা গেছে, তারা আছেন বাংলাদেশেও।

যে পরিণতি হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের

আজ থেকে ২৬৭ বছর আগে পলাশির আম্রকাননের যুদ্ধে বাংলা বিহার ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩২-১৭৫৭) কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রের কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য স্বাধীনতা হারায় বাংলা। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে এই ভূ-ভাগ গোলামির জিঞ্জিরে শৃঙ্খলিত হয়। সেই ইতিহাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আজও সমসাময়িক।

পলাশির প্রান্তরে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সঞ্জিবনী শক্তি নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কি ঘটেছিল সেই ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত প্রায় সবাই। তবে বিশ্বাসঘাতকদের ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটেছিল, এনিয়ে মানুষের কৌতূহল অন্তহীন। ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কখনো ভালো হয় না। পরকালের শাস্তি ভোগের আগেই দুনিয়াতেও তারা লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পলাশী বিয়োগাত্মক ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের বেলায়ও এই সত্যটা প্রমাণিত হয়েছিল।

প্রত্যেক ক্রিয়ার সমমুখী ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটা শুধু বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সমান প্রতিক্রিয়া। তা না হলে যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের মর্মান্তিক পরিণতি হবে কেন।

ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কখনো সুখকর হয় না। পরকালের শাস্তি ভোগের আগেই দুনিয়াতেও তারা অপদস্ত-লাঞ্ছিত, অপমানিত-ঘৃণিত এবং আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। সিরাজ উৎখাতে পলাশী ষড়যন্ত্রে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তাদের অতি করুণ দৃষ্টান্তমূলক পরিণতির বিশদ বিবরণ।কাউকে পাগল হতে হয়েছিল, কারো হয়েছিল অপঘাতে মৃত্যু। কাউকে নির্মম অপমৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল। সবার ভাগ্যে জুটেছিল কোনো না কোনো ভয়াবহ পরিণতি।

বাংলা অভিধানে বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক শব্দ মিরজাফর। বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীরজাফর পবিত্র কুরআন শরিফ মাথায় রেখে নবাবের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করবার পর পরই বেঈমানি করেছিল। তার জামাতা মির কাসেম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের অন্যতম- মীর জাফর, জগৎ শেঠ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, রায় দূর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর কাসেম, ইয়ার লতিফ খান, মহারাজা নন্দকুমার, মিরন, ঘষেটি বেগম, মুহাম্মদী বেগ, দানিশ শাহ বা দানা শাহ, রবার্ট ক্লাইভ, ওয়াটস, স্ক্রাফটন, ওয়াটসন প্রভুত। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলার ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা আমরা কিছুটা জানি। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আজকে আমি আপনাদের সথে আলোচনা করবো। চলুন জেনে নেয়া যাক-

মীরজাফরঃ পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মীরজাফর আলি খান। তিনি পবিত্র কোরআন মাথায় রেখে নবাব সিরাজের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরও বেইমানী করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি ছিলেন জগৎশেঠ ও মীর জাফর জুটি। তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিখণ্ডি। মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরী ১১৭৮ অব্দের ১৪ই শাবান (১৭৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে) বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বৎসর বয়সে পরলোকগত হন। তাহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহার তাহাই শেষ জলপান।

মিরনঃ মিরন ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক। তার পুরো নাম মীর মুহাম্মদ সাদেক আলি খান। তিনি মীরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল। এই সূত্রে মিরন ছিলেন আলিবর্দীর বোনপো। অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা এবং সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন। আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও তিনি। লুৎফুন্নিসার লাঞ্ছনার কারণও মিরন। মীর্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি।

এই মিরনকে হত্যা করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস। তবে তার এই মৃত্যু ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যে ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল। তারা বলেছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশাহ শাহ আলম) সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন। ইংরেজরা বলেছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরে যায় এবং তাতেই তিনি নিহত হন। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টন এই ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন। বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল।

মুহাম্মদীবেগঃ মুহাম্মদীবেগ ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল তার কাছে থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদীবেগ নবাব সিরাজকে সে সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার পরপরই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে, তারপর বিনা কারণে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই মুহাম্মদীবেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন।

জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদ এবং মহারাজা স্বরূপচাঁদঃ পলাশী বিপর্যয়ের নীল নক্সা তিনিই প্রণয়ন করেন। সিরাজের সাথে ইংরেজদের সংঘাত এবং তার বিপর্যয় পর্যন্ত সব কিছুর মধ্যমনি ছিলেন তিনি- আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগৎশেঠের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক গভীর ছিল। নবাব সিরাজ ক্ষমতায় এলে এই গভীরতা আরো বৃদ্ধি পেল এবং তা ষড়যন্ত্রে রূপ নিলো। পলাশী বিপর্যয়ের পর জগৎশেঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশ নেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া গিরিয়া, উধুয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ কর হয়। মহারাজা স্বরূপচাঁদও ঐ সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য হন।

রবার্ট ক্লাইভঃ নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসেন। প্রথমে তিনি একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রের গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। বিরক্তিকর এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ সময় জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ও হতাশা জন্মে। তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি রিভলভার দিয়ে নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি ছোঁড়েন।

কিন্তু গুলি থাকা অবস্থাতেই গুলি রিভলবার থেকে বের হয়নি। পরে তিনি ভাবলেন ঈশ্বর হয়ত তাকে দিয়ে বড় কোন কাজ সম্পাদন করবেন বলেই এভাবে তিনি তাঁকে বাঁচালেন। পরবর্তীতে দ্রুত তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠতে শুরু করেন। পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজেরা তাকে ‘পলাশী হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।

ইয়ার লতিফ খানঃ পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক্ষেত্রে মীর জাফরের নাম উচ্চারিত হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি এই ষড়যন্ত্রের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়িয়েছিলো। তার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যুদ্ধের পর অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। অনেকের ধারণা, তাকে কে বা কারা গোপনে হত্যা করেছিল। (মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট)

মহারাজা নন্দকুমারঃ মহারাজা নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- নন্দকুমার অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে উমিচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলেন।

পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। মীরজাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন। তহবিল তছরূপ ও অন্যান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালত মহারাজা নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করে।

রায় দুর্লভঃ রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধকালে তারই নির্দেশে তার বাহিনী মীরজাফররের সাথে যুক্ত হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।

উমিচাঁদঃ ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হয়েছিলেন। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করলেন, তখন উমিচাঁদ বেঁকে বসলেন এবং বললেন, আপনাদের প্রস্তাব মানতে পারি এক শর্তে, তা হলো যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ৫ ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হবে। ক্লাইভ তার প্রস্তাব মানলেন বটে কিন্তু যুদ্ধের পরে তাকে তা দেয়া হয়নি।

যদিও এ ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হয়েছিল। ওয়াটস রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তিতে তার সই করান। লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের কোষাগারের ৫ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হবে। এটি ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। যাতে করে উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাকে সরাসরি বলেন, আপনাকে কিছু দিতে পারবো না। এ কথা শুনে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে তার মৃত্যু ঘটে।

রাজা রাজবল্লভঃ ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটেছিল। জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করেই পদ্মা নদীর একটি অংশের নাম হয় কীর্তিনাশা।

দানিশ শাহ বা দানা শাহঃ দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে বলেছেন, এই দানিশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, দানিশ শাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিলেন না। আসকার ইবনে শাইখ তাঁর মুসলিম আমলে বাংলার শাসন কর্তা গ্রন্থে লিখেছেন’ বিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল।

ঘষেটি বেগমঃ
মিরনের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

ওয়াটসঃ ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর এনেছিল। যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাজ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। ষড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হলে কোন ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন। 

স্ক্রাফটনঃ
ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন। জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে তার অকালমৃত্যু ঘটে।

মীর কাশিমঃ মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাশিম নবাব সিরাজের খবর পেয়ে ভগবানগোলার ঘাট থেকে তাকে বেঁধে এনেছিলেন মুর্শিদাবাদে। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি নবাব হন এবং এ সময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে। পরে বকসারসহ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পালিয়ে যান এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হয়ে দিল্লীতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। মৃতের শিয়রে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব হিসেবে ব্যবহৃত মীর কাশিমের চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাশিম আলি খান।

এভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সবাই বলেন, পলাশী ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের কর্মফলেই এমন করুণ পরিণতির শিকার হয়েছিলেন।

মীরজাফর কি আসলেই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো ইতিহাস কি বলে

মীরজাফর কি আসলেই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো চলুন জেনে নিই ইতিহাস কি বলে, ইতিহাস বলে মীরজাফর কখনোই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো না। বরং মীরজাফর ছিলো বিশ্বাসঘাতকদের বানানো একটা পুতুল যার নিজের কোন যোগ্যতা ছিলো না। যখনই তার দ্বারা বিশ্বাসঘাতকদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে, তখনই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বিশ্বাসঘাতকরা। বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত চক্রান্তবাজদের চেহারা।

ইতিহাসে মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছিলো অনেক পরে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যে সরাতে হবে তার প্ল্যান অনেক আগেই করেছিলো ৩ হিন্দু বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও রাজবল্লভ মিলে। জগৎশেঠের বাড়িতে এক গোপন মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, সিরাজ-উ-দৌলাকে সরাতে হবে।

সেই মিটিং এ মহিলার ছদ্মবেশে পালকীতে করে যোগ দিয়েছিলো ইংরেজ দূত ওয়াটস। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয় সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে, আবার মুসলমানদের উত্তেজিত করা যাবে না। এ জন্য সিরাজের আত্মীয় মীর জাফরকে বসানো হবে। মি. ওয়াটস তখন বললো-

সিরাজের সাথে লড়তে যে বিরাট অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের কাছে নেই। তখন জগৎশেঠ বললো- টাকা যা দিয়েছি (মানে এতদিন বেঈমান ইংরেজদের সেই টাকা দিতো), আরো যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাবো, কোন চিন্তা নাই।

এই মিটিং এর পর সিরাজকে সরাতে ঘসেটি বেগমকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো রাজা রাজবল্লভের উপর। আর মীরজাফরকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো উমিচাঁদের উপর। ‍উমিচাঁদ মীরজাফরকে লোভ দেখায়, তুমি আমাদের দলে থাকলে তোমাকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো হবে। (বি: দ্র: যারা ব্রিটিশদের দালালি করতে পারতো, তাদেরকে রাজা উপাধি দেওয়া হতো। যেমন রাজা রামমোহন রায়, রাজা নবকৃষ্ণ)।

এরপর জগৎশেঠের বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত থাকে জগৎশেঠ, রাজা মহেন্দ্ররায় (রায় দুর্লভ), রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও মীরজাফর। ঐ মিটিংয়ে এক হিন্দু ডাইরেক্ট বলে বসে, যবনকে নবাব না করে হিন্দু নবাব করা হোক।

তখন কৃষ্ণচন্দ্র মীর জাফরের দিকে দৃষ্টিপাত করে থতমত খেয়ে যায় এবং বলে- না, আমরা মীরজাফরকে দিয়েই সিরাজকে সরাতে চাই। উদ্দেশ্য ছিলো- মুসলমানগণ ক্ষেপে উঠবে না, মুসলমান নবাবের পরিবর্তে মুসলমান নবাব হবে মাত্র। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক তর্ক হয়। তখন জগৎশেঠ বলে- কৃষ্ণচন্দ্রের কথাই ঠিক আছে। আমরা কেউ নবাব হলে বিপদ আছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মীরজাফর ছিলো যোগত্যাহীন এক খেলার পুতুলমাত্র, পেছন থেকে মূল কলকাঠি নেড়েছিলো হিন্দুরা। দিয়েছিলো সমর্থন ও পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ।

এখন বলতে পারেন, জগৎশেঠ কিভাবে টাকা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? তার ব্যক্তিগত টাকা সে দিতেই পারে।

কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। শেঠ পরিবারের পূর্ব পুরুষ হীরানন্দ ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র, যারা অভাবের জ্বালায় নিজ ভিটামাটি ত্যাগ করেছিলো। মুসলমান নবাব ও সম্রাটদের ছাত্রছায়ায় তারা পেয়েছিলো অর্থসম্পদ। এই ‘শেঠ’ উপাধিও মুসলমানদের দেওয়া। মুসলিম সম্রাট ও নবাবদের দয়াদানেই এত টাকার মালিক হয়ে ওঠে শেঠ পরিবার।

শেঠ পরিবার সব সময় মুসলিম শাসকদের তোষণ করতো, ফলে শেঠ পরিবারের উপর সব সময় মুগ্ধ থাকতো সম্রাটরা। সম্রাট মুহম্মদ শাহ জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলো এবং তার জন্য মতির মালা ও হাতি উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলো। উল্লেখ্য, মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তার বাড়ির টাকা শেঠদের বাড়িতে জমা রাখা হয়েছিলো, যার পরিমাণ ঐ সময় ৭ কোটি টাকা।, যা শেঠ পরিবার আর ফেরত দেয়নি।

অর্থাৎ মুসলমানদের থেকে পাওয়া অর্থই মুসলিম শাসন অবসান করতে ব্যবহার করেছিলো জগৎশেঠ। এ জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ মীর জাফরের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা নয় বরং হিন্দু মহাজনদের টাকাকেই মূখ্য করেছে। এ সম্পর্কে এক ইংরেজ ঐতিহাসিকরা বলে-The Rupees of the Hindu banker, equally with the sward of the English colonel contributed to the overthrough of the Mahammedan power in Bengla.

উপরের ইংরেজী বক্তব্যে স্পষ্ট লেখা - ‘মুসলমানদের শাসনের পতন ঘটাতে দুটি জিনিস কাজ করেছে - প্রথমত হিন্দুদের টাকা, দ্বিতীয়ত্ব ইংরেজদের তরবারি। এতে বোঝা যাচ্ছে, ঐ সময় ঐতিহাসিকদের কাছে মুসলিম শাসন অবসানের জন্য মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকার খুব একটা মূল্য ছিলো না।

উল্লেখ্য, সিরাজ-উদ-দৌলা পতনের মত ঘটনার গোড়ার ঘটনা হচ্ছে ইংরেজদের কলকাতা দুর্গ নির্মাণ করা। এই দুর্গ নির্মাণকে কেন্দ্র করেই সিরাজের সাথে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব বাধে, যার অনেক পরের ফল হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ। ইতিহাস বলছে, ঐ দুর্গ নির্মাণের মত অর্থ ইংরেজদের ছিলো না, সেই অর্থ কিন্তু দিয়েছিলো রাজবল্লভ।আলীবর্দীর আমলে প্রজাদের সর্বনাশ করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলো সামান্য কেরানী রাজবল্লভ।

সেই টাকা নিজপুত্র কৃষ্ণরায়ের মারফত দুর্গ নির্মাণে পাচার করেছিলো রাজবল্লভ। দুর্গ নির্মাণের পরই কলকাতায় অভিযান চালিয়েছিলো নবাব। এ সময় গ্রেফতার হয় বিশ্বাসঘাতক হলওয়েল, কৃষ্ণদাস ও উমিচাঁদ। কিন্তু সিরাজের অপরাধ ছিলো, সে ঐ তিন বিশ্বাঘাতকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তিনজনকেই ক্ষমা করে দেয়। যার ফল নবাবকে পরে পেতে হয়েছিলো।

এখানে একটা কথা উঠে হিন্দুরা কেন নবাব সিরাজের মূলকেন্দ্র তথা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের পতন চাইবে ?

এর উত্তর হতে পারে, হয়ত মনে মনে মুর্শিদাবাদকে কখনই সহ্য করতে পারতো না হিন্দুরা। কারণ মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী করেছিলো মুর্শিদকুলী খান, যেই মুর্শিদ কুলী খান আগে ছিলো এক কুলীন ব্রাহ্মণ, যে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যায়। এই কারণে মুর্শিদাবাদের উপর ক্ষোভ বা হিংসা ছিলো গোঁড়া হিন্দুদের।

আবার অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, একজন শেঠ (জগৎশেঠ) কিভাবে একজন নবাবকে সরিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করলো

এর উত্তর হচ্ছে, ঐ সময় অর্থকড়ির একটা বড় হিসেব হতো এই শেঠ পরিবারের মাধ্যমে। মুসলিম শাসকদের তোষণ করে তারা সে সুযোগটা আদায় করে নিয়েছিলো। সারা ভারতের বহু স্থানেই তাদের গদি ছিলো। ইংরেজরা শেঠ পরিবারের নাম দিয়েছিলো ‘ব্যাংকার’। বর্তমানে যারা ইহুদীদের রথচাইল্ড পরিবার সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের জন্য বিষয়টি বুঝতে সোজা হবে।

বর্তমানে সারা বিশ্বের শাসক কে হবে, আর কে না হবে, এটা পর্দার আড়াল থেকে মূল চাবিকাঠি নাড়ে রথচাইল্ড পরিবার। এরা টাকার জোরে মূল কাজটি করে থাকে। ঐ সময়ও টাকার জোরে জগৎশেঠ পেছন থেকে বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিলো।

সত্যিই বলতে, ইতিহাস পড়লে একটা স্বল্প শিক্ষিত লোকও বুঝতে পারবে বাংলার শাসন অবসানে মীর জাফর ছিলো একটা পুতুল মাত্র। কারণ তাকে সিংহাসনে বসানোর পর তার কোন ক্ষমতা ছিলো না, তাকে যা বলা হতো সে তাই করতো। তাও মাত্র ৩ বছরের মাথায় তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর বসানো হয় মীরকাশেমকে। দেখা গেলো মীরকাশেম যখন জগৎশেঠের বিরুদ্ধে গেলো, তখনই ইংরেজরাই মীরকাশেমের বিরুদ্ধচারণ শুরু করলো। এর দ্বারা প্রমাণ হয় মীরজাফর ও মীরকাশেমের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক, ইংরেজ ও জগৎশেঠ তথা হিন্দুদের সাথে সম্পর্কের তুলনায় কিছুই ছিলো না।

মীরজাফর কে ছিলেন

আপনারা সবাই মীরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক জানেন, আসলে কে এই মীরজাফর চলুন জেনে নেওয়া যাক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার তাবেদার নবাব, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌলার সাথে ইস্ট ইন্ডিজ'র লর্ড ক্লাইভের সাথে যুদ্ধের সময়, সিরাজউদৌলার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। এই সূত্রে যে কোন বিশ্বাস ঘাতককে বাংলা ভাষায় 'মীরজাফর' হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মীরজাফর এর পুরো নাম মীর জাফর আলী খান। ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মীরজাফর নবাব সিরাজউদৌলার একজন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও সিরাজউদ্দৌলার বিপক্ষেই কাজ করেছেন।

১৭৫৭ সালে ২৩ জুন। নদীয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাহাদুর নবাবের নির্দেশ উপেক্ষা করে ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ নেননি।

ফলে, যুদ্ধে পালাতে হয়েছিল সিরাজউদ্দৌলাকে। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে ব্রিটিশদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ভারত বর্ষে। ফলে মীর জাফরকে ইতিহাস ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবকে পরাজিত করা এবং হত্যাকে ইতিহাস ‘কলঙ্কজনক’ অধ্যায় বলেও চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে আজ তা অমোচনীয়।

ব্রিটিশদের আশীর্বাদে নবাব হিসাবে জায়গা পেলেও মীর জাফর আলি খান বাহাদুর, পলাশীর যুদ্ধের ৯ বছর পর ১৭৬৫ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

মীরজাফরের বংশধরেরা এখন যেভাবে বেঁচে আছেন

আপনারা সবাই জানেন, প্রাচীন ভারতে বাংলা বিহার ওড়িশার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মীরজাফর সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এই সূত্রে যে কোন বিশ্বাসঘাতককে বাংলা ভাষায় 'মীরজাফর' হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর সেই মীরজাফরের বংশধররা আছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে।
মীরজাফরের-বংশধরেরা-এখন-যেভাবে-বেঁচে-আছেন
মীরজাফরের বংশধরদের একজন, রেজা আলি মির্জা। তবে তিনি মির্জা পদবি ব্যবহার করেন না। মীরজাফরের হাজারদুয়ারি প্যালেসেও থাকেন না। কারণ এ বাসার গেটেই স্থানীয়রা লিখে দিয়েছে ‘ নেমকহারাম’ গেট। মানুষ আসা যাওয়ার পথে থুথু ফেলে।

ফলে রেজা আলি , অনেকের কাছে পরিচিত জাফর আলি রেজা তিনি লালবাগ এলাকায় দোতলা বাসা বানিয়ে বসবাস করছেন মীরজাফরের পরিচয় গোপন করে। তিনি শিক্ষকতা করতেন। মানুষ ভালো। স্থানীয় কবি সলিল ঘোষের মতে, তার মতো মানুষ হয় না। তবুও পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের দায়ে তাকে পরিচয় গোপন করে চলতে হয়।

তবে রেজা আলির ছেলে মীর জাফরের নবম বংশধর ফাহিম জানান, এলাকার লোকজন তাদের কোন ধরনের বিরক্ত করে না-কারণ এলাকার সবাই জানেন মীর জাফরের বিষয়টা নিয়ে আসলে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাছাড়া কেউ এখনো জানেনা আসলে পলাশীর যুদ্ধে কি হয়েছিল। এমন ও হতে পারে, তখন ইংরেজরা কোন না কোনভাবে মীর জাফরকে বাধ্য করেছিল যার জন্য সে এভাবে বেইমানি করতে বাধ্য হয়েছিলো।

আপনি মুখে যা ই বলুন আসল ঘটনা ,মীরজাফরের বংশধরেরা নিজেদের বংশ পরিচয় দিতে চান না সহজে। তিনি এমএ পাশ করে চাকরি খুঁজছেন। মোদি সরকারের আমলে চাকরি পাবেন বলে মনে করেন না ফাহিমের বন্ধু তারিক। তাই ফাহিম অন্যত্র চলে গিয়ে ব্যবসার চিন্তা করছেন।

বেশ কিছুদিন আগে মীরজাফরের অষ্টম বংশধর, মানে ফাহিমের বাবা অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক রেজা আলি তার বাড়িতে থাকা বিভিন্ন দলিল, প্রমাণাদি ইত্যাদি একত্রিত করে একটা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘ মীর জাফর বেইমান নয়!’

এই বই প্রকাশের পরপরেই পুরো মিডিয়া এবং ভারত জুড়ে তোলপাড় লেগে যায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি এই বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হোন।

রেজা আলির বাল্যবন্ধু সলিল ঘোষ বলেন, তাদের দোষ তো একটাই, তারা মীরজাফরের বংশে জন্মগ্রহণ করেছে। এছাড়া তো তাদের আর কোন দোষ নেই, তারা তো পলাশীর যুদ্ধও করেনি, নবাব সিরাজউদ্দোলার সাথে বেইমানিও করেনি। কিন্তু তবুও তাদেরকে সমাজে আজও ঘৃণিত হয়ে থাকতে হচ্ছে, এটা অন্যায়।

উপসংহার

নানা নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুতে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে মসনদে বসেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নবাব দেখেন চারিদিকে দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্ত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাস্ত হন। ফলে ১৯০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

অতএব, আশা করছি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ, পলাশীর যুদ্ধ কোথায় সংঘটিত হয়েছিল এবং পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন কেন এ সমস্ত বিষয়গুলো এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url