আপনি কি জানেন পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার নবাব কে ছিলেন? অনেকেই হয়তো জানেন না যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার নবাব কে ছিলেন। মীরজাফর নবাব হওয়ার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে 'রাজস্ব ইউনিট' দিয়েছিলেন। প্রশাসনের এই ব্যবস্থা শের শাহ সুরি বা সুরি সাম্রাজ্য দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। মুঘল শাসনামলে, চব্বিশ পরগণার অঞ্চল সাতগাঁও (প্রাচীন ও মধ্যযুগে কিছু সময়ের জন্য দক্ষিণ বাংলার রাজধানী ছিল একটি প্রধান বন্দর) প্রশাসনের অধীনে ছিল।
মুঘল শাসনের অবসানের পর, প্রশাসন হুগলি চাকলায় স্থানান্তরিত হয়, যেটি মুর্শিদকুলি খানের (বাংলার প্রথম নবাব) অধীনে ছিল। ১৭৫৭ সালে মীরজাফর নবাব হতে চেয়েছিলেন। তিনি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং পলাশীর যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন। যা মীরজাফরকে নবাব হতে দেয়। যেহেতু ব্রিটিশরাই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করেছিল এবং নবাবকে পরাজিত করেছিল, তাই ব্রিটিশরা চব্বিশ পরগণার জমিদারি দাবি করেছিল। তাই, মীরজাফর চব্বিশ পরগণার সমস্ত কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে অর্পণ করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়, সুন্দরবনের আশেপাশের পরগণার কিছু অংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার একটি অংশ করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে, একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির পরামর্শ অনুসারে 24 পরগনা দুটি জেলায় বিভক্ত। ১লা মার্চ ১৯৮৩ সালে, বিভাগটি কার্যকর করা হয় এবং দুটি জেলা তৈরি করা হয়; উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর কে বা করা সে সম্পর্কে আমরা হয়তো সঠিক ধারনা রখিনা। তবে যেহেতু সিরাজউদ্দৌলা বাংলার একজন নবাব ছিলেন সেহেতু তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বংশধর ও ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরী। ভাগীরথী থেকে বুড়িগঙ্গা, মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা। রাজকীয় হীরাঝিল প্রাসাদ থেকে ঢাকা শহরের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা।একদা বাংলা, বিহার, ওড়িশার আকাশ বাতাস কেঁপে উঠতো যাদের হুংকারে। ভাগিরথীর তীরে মুর্শিদাবাদ নগরে আলোকোজ্জ্বল মহল সর্বদা সরগরম থাকতো। যে দাপুটে নবাবের পদচারণায় সুবে বাংলার সেই শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরেরা এখন ঢাকা শহরে বসবাস করছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নীরবে নিভৃতে। অনেকেই তাদের খবর জানে না, অনেকেই খবর নেয় না। নবাব সিরাজউদদৌলা বাঙালি ছিলেন না, তিনি বাংলার ছিলেন না কিন্তু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। ভালবাসতেন বাংলাকে, বাঙালিকে।
আলিবর্দী খাঁ ইরান থেকে এসে ১৭৪০ সালে ৬৬ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। নবাব সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন আলিবার্দি খানের খুবই আদরের নাতি। নবাব সিরাজ উদ দৌলার জন্ম হয় ১৭৩৩ ( মতান্তরে ১৭৩৩ , ১৭২৭ ) খ্রিস্টাব্দে, জুলাই মাসের ২ তারিখ রাজমহলে এবং মৃত্যু হলো ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। কারো মতে জন্ম ১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর।
১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয় এবং ২রা জুলাই ঘাতকের হাতে তার প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় বহুকালের জন্য। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
সিরাজের পিতা জাইন উদ্দিন ছিলেন বিহারের নবাব ও আলী ওয়ার্দি খানের বড় ভাই, হাজী আহমেন্দের ছেলে। এবং তার মা, আমিনা বেগম ছিলেন নবাব আলী ওয়ার্দি খানের সর্ব কনিষ্ট মেয়ে। যেহেতু আলী ওয়ার্দি খানের কোনো ছেলে ছিল না, সিরাজ, তার নাতি হিসেবে, তার মনের অনেক কাছে ছিল এবং সিরাজের বাল্যকাল থেকেই, ওকে, মুর্শিদাবাদ এর উত্তরসুরী হিসেবে দেখা হত।
তার অনুসারে, সিরাজকে নবাবের দুর্গে, সকল সুযোগ, সুবিদা এবং শিক্ষা দেওয়া হয়, ভবিষ্যতের নবাব হিসেবে। ১৭৪৬ সালে, বাল্য সিরাজ তার নানা, আলী ওয়ার্দিকে, মিরাথাস্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করে। ১৭৫২ সালে, ১৯ বছর বয়সী সিরাজকে, তার নানা, আলী ওয়ার্দি, তার উত্তরসুরী (আলী ওয়ার্দির রাজ্যের নবাব) হিসেবে ঘোষিত করে এবং তার রক্তের অন্য কাউকে তার কোনো সম্পত্তির মালিক করে নি।
সিরাজউদ্দৌলার প্রকৃত নাম মীর্জা মুহম্মদ আলী। সিরাজ উদ দৌলার আরেক নাম ছিল Sir Roger Dowllet বা সার রজার দৌলেত, কারণ অনেক ইংরেজরা তার নাম উচ্চারণ করতে পারত না।
আমাদের এই ঢাকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা হয়ে আছে নবাব পরিবারের দুর্দিন, দুঃসময়ের জীবন। সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুননিসা, একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরা, নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসা সহ নবাব পরিবারের নারীদের ৮ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা পাড়ের জিঞ্জিরা এলাকার একটি প্রাসাদে। স্থানীয় লোকজন ওই জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে এখনও জানে ‘নাগরা’ নামে। বর্তমানে ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড-এর বৈকালী টাওয়ারে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা।
তাদের একজন সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব। তিনি কাজ করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে। বর্তমানে ড. ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক পলাশী পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ওই বাসাতেই আছেন তার পিতা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা। তিনি নবাব সিরাজউদদৌলার ৮ম বংশধর। তার প্রয়াত স্ত্রী সৈয়দা হোসনেআরা বেগম ছিলেন নবাবের স্ত্রী লুৎফুননিসার রক্তের উত্তরাধিকার। এখানেই বাস করছেন তিনি এবং তার ২ ছেলে গোলাম আব্বাস আরেব ও ইমু এবং ২ কন্যা মাসুমা ও মুনমুন।
নবাব পরিবারের নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেবের পূর্ববর্তী বংশধরের কুষ্ঠি বিশ্লেষণ করে জানা যায়ঃ-
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার মেয়ে উম্মে জোহরা ওরফে কুদসিয়া বেগম (প্রথম বংশধর)
- জোহরার ছেলে শমসের আলী খান (দ্বিতীয় বংশধর)
- তাঁর ছেলে লুৎফে আলী (তৃতীয় বংশধর)
- লুৎফের মেয়ে ফাতেমা বেগম (চতুর্থ বংশধর)
- তাঁর মেয়ে হাসমত আরা বেগম (পঞ্চম বংশধর)
- হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকি রেজা (ষষ্ঠ বংশধর)
- তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম মোর্তজা (সপ্তম বংশধর)
- গোলাম মোর্তজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তফা (অষ্টম বংশধর)
- এবং তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব (নবম বংশধর)
কিভাবে তারা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরঃ
নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরদের বংশতালিকার হিসাব দিলেন গোলাম আব্বাস আরেব। ইরান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বাংলায় আসা নবাব আলীবর্দী খানের কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার ছিল ৩ কন্যা। ঘসেটি বেগম, ময়মুনা বেগম ও আমেনা বেগম। আলীবর্দী খানের বড় ভাই হাজী মির্জা আহমেদের ছিল ৩ পুত্র। মুহাম্মদ রেজা, মুহাম্মদ সাঈদ ও মুহাম্মদ জয়েনউদ্দিন। আলীবর্দী খানের ৩ কন্যাকে বিয়ে দেন তার ভাই হাজী আহমেদের ৩ পুত্রের সঙ্গে।
মুহাম্মদ রেজার সঙ্গে বিয়ে দেন ঘসেটি বেগমের। মুহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে ময়মুনা বেগমের এবং আমেনা বেগমের বিয়ে দেন জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। জয়েনউদ্দিন ও আমেনা বেগমের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। তাদের বড় সন্তান নবাব সিরাজউদদৌলা, অপর ২ ছেলে হচ্ছেন ইকরামউদদৌলা ও মির্জা মেহেদি। ২ কন্যা আসমাতুন নেসা ও খায়রুন নেসা।
নবাব সিরাজউদদৌলা বিয়ে করেন ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুননিসাকে। ইরাজ খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মোঘল দরবারের কর্মকর্তা। সিরাজউদদৌলার একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরা বেগম। সিরাজউদদৌলার যখন মৃত্যু হয় তখন উম্মে জহুরা শিশু। সিরাজ কন্যা জহুরা বেগমের বিয়ে হয় সিরাজের ভাই একরামউদদৌলার পুত্র মুরাদউদদৌলার সঙ্গে।
তাদের একমাত্র পুত্র শমসের আলী। তার পুত্র সৈয়দ লুৎফে আলী। তার কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার একমাত্র কন্যা ফাতেমা বেগম। ফাতেমা বেগমের ২ কন্যা হাসমত আরা বেগম ও লুৎফুননিসা বেগম। লুৎফুননিসা নিঃসন্তান। হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকির রেজা। তার ছেলে সৈয়দ গোলাম মর্তুজা। সৈয়দ গোলাম মর্তুজার ছেলে এই সৈয়দ গোলাম মোস্তফা।
২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পর ২৫শে জুন নবাব সিরাজউদদৌলা স্ত্রী লুৎফুননিসা ও শিশুকন্যা জহুরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আবার সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলা উদ্ধার করতে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ভগবানগোলায় ক্ষুধার্ত নবাব পরিবার দানা শাহ নামের এক লোকের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ কালে ওই ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেন নবাব সিরাজউদদৌলাকে। সেখানে গিয়ে মীর জাফরের ছেলে মিরন গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন নবাবকে। বন্দি অবস্থায় ২রা জুলাই মোহাম্মদী বেগ হত্যা করে নবাব তাকে।
নবাবকে হত্যার পর তার স্ত্রী শিশুকন্যা সহ নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন নেসাকে নৌকায় করে ভাগীরথীর তীর থেকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিঞ্জিরার একটি প্রাসাদে তাদের আটকে রাখা হয় ৮ বছর। সেখান থেকে আবার তাদের মুর্শিদাবাদে নিয়ে মুক্ত করা হয়। নবাব সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোন চাকরি দেয়নি বৃটিশ সরকার।
নবাবের ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর কাছে এসে ধরনা দিলে ১৯১৩ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর তিনি বাংলার গভর্নরের নিকট কাছে তাকে একটি চাকরি দেয়ার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় তিনি সিরাজউদদৌলার বংশধর। সে অনুরোধের প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার সৈয়দ জাকি রেজাকে মুর্শিদাবাদের ডেপুটি সাব-রেজিস্টার পদে নিয়োগ দেন। তার পুত্র সৈয়দ গোলাম মর্তুজা চাকরি করতেন মুর্শিদাবাদের কালেক্টরেট বিভাগে।
সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। প্রথমে আসেন রাজশাহীতে, রাজশাহী থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী হন।
১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলে লোহানী তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান (বিটিভি-তে প্রচারিত) 'যদি কিছু মনে না করেন'-এ জনাব ,সৈয়দ গোলাম মুর্তজা-কে পরিচিত করিয়ে দেন । গোলাম মর্তুজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা পাকিস্তান আমলে চাকরি নেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে। তিনি এখন ছেলে সন্তান সহ বসবাস করছেন ঢাকা শহরে।
তার বড় ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব সমাজের গুণীজন, বিত্তবান সহ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা নবাব সিরাজউদদৌলার নামে একটি একাডেমী স্থাপন করতে চান। সে জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে বসবাস করা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে এখনও কি যেন এক ধরনের অজানা আতঙ্ক তাদের মাঝে।
সম্ভবত সে আতঙ্ক থেকেই অন্তর্মুখী প্রচারবিমুখ হয়ে আছেন তারা। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মীর জাফরের বংশধররা স্ব-স্ব পরিচয় দিয়ে দাপটে আছেন। জানা গেছে, তারা আছেন বাংলাদেশেও।
যে পরিণতি হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের
আজ থেকে ২৬৭ বছর আগে পলাশির আম্রকাননের যুদ্ধে বাংলা বিহার ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩২-১৭৫৭) কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রের কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য স্বাধীনতা হারায় বাংলা। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে এই ভূ-ভাগ গোলামির জিঞ্জিরে শৃঙ্খলিত হয়। সেই ইতিহাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আজও সমসাময়িক।
পলাশির প্রান্তরে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সঞ্জিবনী শক্তি নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কি ঘটেছিল সেই ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত প্রায় সবাই। তবে বিশ্বাসঘাতকদের ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটেছিল, এনিয়ে মানুষের কৌতূহল অন্তহীন। ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কখনো ভালো হয় না। পরকালের শাস্তি ভোগের আগেই দুনিয়াতেও তারা লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পলাশী বিয়োগাত্মক ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের বেলায়ও এই সত্যটা প্রমাণিত হয়েছিল।
প্রত্যেক ক্রিয়ার সমমুখী ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটা শুধু বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সমান প্রতিক্রিয়া। তা না হলে যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের মর্মান্তিক পরিণতি হবে কেন।
ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কখনো সুখকর হয় না। পরকালের শাস্তি ভোগের আগেই দুনিয়াতেও তারা অপদস্ত-লাঞ্ছিত, অপমানিত-ঘৃণিত এবং আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। সিরাজ উৎখাতে পলাশী ষড়যন্ত্রে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তাদের অতি করুণ দৃষ্টান্তমূলক পরিণতির বিশদ বিবরণ।কাউকে পাগল হতে হয়েছিল, কারো হয়েছিল অপঘাতে মৃত্যু। কাউকে নির্মম অপমৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল। সবার ভাগ্যে জুটেছিল কোনো না কোনো ভয়াবহ পরিণতি।
বাংলা অভিধানে বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক শব্দ মিরজাফর। বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীরজাফর পবিত্র কুরআন শরিফ মাথায় রেখে নবাবের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করবার পর পরই বেঈমানি করেছিল। তার জামাতা মির কাসেম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতকদের অন্যতম- মীর জাফর, জগৎ শেঠ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, রায় দূর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর কাসেম, ইয়ার লতিফ খান, মহারাজা নন্দকুমার, মিরন, ঘষেটি বেগম, মুহাম্মদী বেগ, দানিশ শাহ বা দানা শাহ, রবার্ট ক্লাইভ, ওয়াটস, স্ক্রাফটন, ওয়াটসন প্রভুত। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলার ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা আমরা কিছুটা জানি। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আজকে আমি আপনাদের সথে আলোচনা করবো। চলুন জেনে নেয়া যাক-
মীরজাফরঃ পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মীরজাফর আলি খান। তিনি পবিত্র কোরআন মাথায় রেখে নবাব সিরাজের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরও বেইমানী করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি ছিলেন জগৎশেঠ ও মীর জাফর জুটি। তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিখণ্ডি। মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরী ১১৭৮ অব্দের ১৪ই শাবান (১৭৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে) বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বৎসর বয়সে পরলোকগত হন। তাহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহার তাহাই শেষ জলপান।
মিরনঃ মিরন ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক। তার পুরো নাম মীর মুহাম্মদ সাদেক আলি খান। তিনি মীরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল। এই সূত্রে মিরন ছিলেন আলিবর্দীর বোনপো। অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা এবং সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন। আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও তিনি। লুৎফুন্নিসার লাঞ্ছনার কারণও মিরন। মীর্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি।
এই মিরনকে হত্যা করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস। তবে তার এই মৃত্যু ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যে ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল। তারা বলেছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশাহ শাহ আলম) সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন। ইংরেজরা বলেছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরে যায় এবং তাতেই তিনি নিহত হন। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টন এই ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন। বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল।
মুহাম্মদীবেগঃ মুহাম্মদীবেগ ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল তার কাছে থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদীবেগ নবাব সিরাজকে সে সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার পরপরই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে, তারপর বিনা কারণে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই মুহাম্মদীবেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন।
জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদ এবং মহারাজা স্বরূপচাঁদঃ পলাশী বিপর্যয়ের নীল নক্সা তিনিই প্রণয়ন করেন। সিরাজের সাথে ইংরেজদের সংঘাত এবং তার বিপর্যয় পর্যন্ত সব কিছুর মধ্যমনি ছিলেন তিনি- আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগৎশেঠের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক গভীর ছিল। নবাব সিরাজ ক্ষমতায় এলে এই গভীরতা আরো বৃদ্ধি পেল এবং তা ষড়যন্ত্রে রূপ নিলো। পলাশী বিপর্যয়ের পর জগৎশেঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশ নেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া গিরিয়া, উধুয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ কর হয়। মহারাজা স্বরূপচাঁদও ঐ সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য হন।
রবার্ট ক্লাইভঃ নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসেন। প্রথমে তিনি একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রের গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। বিরক্তিকর এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ সময় জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ও হতাশা জন্মে। তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি রিভলভার দিয়ে নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি ছোঁড়েন।
কিন্তু গুলি থাকা অবস্থাতেই গুলি রিভলবার থেকে বের হয়নি। পরে তিনি ভাবলেন ঈশ্বর হয়ত তাকে দিয়ে বড় কোন কাজ সম্পাদন করবেন বলেই এভাবে তিনি তাঁকে বাঁচালেন। পরবর্তীতে দ্রুত তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠতে শুরু করেন। পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজেরা তাকে ‘পলাশী হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ইয়ার লতিফ খানঃ পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক্ষেত্রে মীর জাফরের নাম উচ্চারিত হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি এই ষড়যন্ত্রের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়িয়েছিলো। তার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যুদ্ধের পর অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। অনেকের ধারণা, তাকে কে বা কারা গোপনে হত্যা করেছিল। (মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট)
মহারাজা নন্দকুমারঃ মহারাজা নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- নন্দকুমার অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে উমিচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলেন।
পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। মীরজাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন। তহবিল তছরূপ ও অন্যান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালত মহারাজা নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করে।
রায় দুর্লভঃ রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধকালে তারই নির্দেশে তার বাহিনী মীরজাফররের সাথে যুক্ত হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।
উমিচাঁদঃ ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হয়েছিলেন। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করলেন, তখন উমিচাঁদ বেঁকে বসলেন এবং বললেন, আপনাদের প্রস্তাব মানতে পারি এক শর্তে, তা হলো যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ৫ ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হবে। ক্লাইভ তার প্রস্তাব মানলেন বটে কিন্তু যুদ্ধের পরে তাকে তা দেয়া হয়নি।
যদিও এ ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হয়েছিল। ওয়াটস রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তিতে তার সই করান। লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের কোষাগারের ৫ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হবে। এটি ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। যাতে করে উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাকে সরাসরি বলেন, আপনাকে কিছু দিতে পারবো না। এ কথা শুনে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে তার মৃত্যু ঘটে।
রাজা রাজবল্লভঃ ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটেছিল। জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করেই পদ্মা নদীর একটি অংশের নাম হয় কীর্তিনাশা।
দানিশ শাহ বা দানা শাহঃ দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে বলেছেন, এই দানিশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, দানিশ শাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিলেন না। আসকার ইবনে শাইখ তাঁর মুসলিম আমলে বাংলার শাসন কর্তা গ্রন্থে লিখেছেন’ বিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল।
ঘষেটি বেগমঃ মিরনের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
ওয়াটসঃ ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর এনেছিল। যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাজ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। ষড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হলে কোন ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন।
স্ক্রাফটনঃ ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন। জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে তার অকালমৃত্যু ঘটে।
মীর কাশিমঃ মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাশিম নবাব সিরাজের খবর পেয়ে ভগবানগোলার ঘাট থেকে তাকে বেঁধে এনেছিলেন মুর্শিদাবাদে। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি নবাব হন এবং এ সময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে। পরে বকসারসহ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পালিয়ে যান এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হয়ে দিল্লীতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। মৃতের শিয়রে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব হিসেবে ব্যবহৃত মীর কাশিমের চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাশিম আলি খান।
এভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সবাই বলেন, পলাশী ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের কর্মফলেই এমন করুণ পরিণতির শিকার হয়েছিলেন।
মীরজাফর কি আসলেই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো ইতিহাস কি বলে
মীরজাফর কি আসলেই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো চলুন জেনে নিই ইতিহাস কি বলে, ইতিহাস বলে মীরজাফর কখনোই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিলো না। বরং মীরজাফর ছিলো বিশ্বাসঘাতকদের বানানো একটা পুতুল যার নিজের কোন যোগ্যতা ছিলো না। যখনই তার দ্বারা বিশ্বাসঘাতকদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে, তখনই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বিশ্বাসঘাতকরা। বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত চক্রান্তবাজদের চেহারা।
ইতিহাসে মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছিলো অনেক পরে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যে সরাতে হবে তার প্ল্যান অনেক আগেই করেছিলো ৩ হিন্দু বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও রাজবল্লভ মিলে। জগৎশেঠের বাড়িতে এক গোপন মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, সিরাজ-উ-দৌলাকে সরাতে হবে।
সেই মিটিং এ মহিলার ছদ্মবেশে পালকীতে করে যোগ দিয়েছিলো ইংরেজ দূত ওয়াটস। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয় সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে, আবার মুসলমানদের উত্তেজিত করা যাবে না। এ জন্য সিরাজের আত্মীয় মীর জাফরকে বসানো হবে। মি. ওয়াটস তখন বললো-
সিরাজের সাথে লড়তে যে বিরাট অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের কাছে নেই। তখন জগৎশেঠ বললো- টাকা যা দিয়েছি (মানে এতদিন বেঈমান ইংরেজদের সেই টাকা দিতো), আরো যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাবো, কোন চিন্তা নাই।
এই মিটিং এর পর সিরাজকে সরাতে ঘসেটি বেগমকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো রাজা রাজবল্লভের উপর। আর মীরজাফরকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিলো উমিচাঁদের উপর। উমিচাঁদ মীরজাফরকে লোভ দেখায়, তুমি আমাদের দলে থাকলে তোমাকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো হবে। (বি: দ্র: যারা ব্রিটিশদের দালালি করতে পারতো, তাদেরকে রাজা উপাধি দেওয়া হতো। যেমন রাজা রামমোহন রায়, রাজা নবকৃষ্ণ)।
এরপর জগৎশেঠের বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত থাকে জগৎশেঠ, রাজা মহেন্দ্ররায় (রায় দুর্লভ), রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও মীরজাফর। ঐ মিটিংয়ে এক হিন্দু ডাইরেক্ট বলে বসে, যবনকে নবাব না করে হিন্দু নবাব করা হোক।
তখন কৃষ্ণচন্দ্র মীর জাফরের দিকে দৃষ্টিপাত করে থতমত খেয়ে যায় এবং বলে- না, আমরা মীরজাফরকে দিয়েই সিরাজকে সরাতে চাই। উদ্দেশ্য ছিলো- মুসলমানগণ ক্ষেপে উঠবে না, মুসলমান নবাবের পরিবর্তে মুসলমান নবাব হবে মাত্র। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক তর্ক হয়। তখন জগৎশেঠ বলে- কৃষ্ণচন্দ্রের কথাই ঠিক আছে। আমরা কেউ নবাব হলে বিপদ আছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মীরজাফর ছিলো যোগত্যাহীন এক খেলার পুতুলমাত্র, পেছন থেকে মূল কলকাঠি নেড়েছিলো হিন্দুরা। দিয়েছিলো সমর্থন ও পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ।
এখন বলতে পারেন, জগৎশেঠ কিভাবে টাকা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? তার ব্যক্তিগত টাকা সে দিতেই পারে।
কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। শেঠ পরিবারের পূর্ব পুরুষ হীরানন্দ ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র, যারা অভাবের জ্বালায় নিজ ভিটামাটি ত্যাগ করেছিলো। মুসলমান নবাব ও সম্রাটদের ছাত্রছায়ায় তারা পেয়েছিলো অর্থসম্পদ। এই ‘শেঠ’ উপাধিও মুসলমানদের দেওয়া। মুসলিম সম্রাট ও নবাবদের দয়াদানেই এত টাকার মালিক হয়ে ওঠে শেঠ পরিবার।
শেঠ পরিবার সব সময় মুসলিম শাসকদের তোষণ করতো, ফলে শেঠ পরিবারের উপর সব সময় মুগ্ধ থাকতো সম্রাটরা। সম্রাট মুহম্মদ শাহ জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলো এবং তার জন্য মতির মালা ও হাতি উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলো। উল্লেখ্য, মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তার বাড়ির টাকা শেঠদের বাড়িতে জমা রাখা হয়েছিলো, যার পরিমাণ ঐ সময় ৭ কোটি টাকা।, যা শেঠ পরিবার আর ফেরত দেয়নি।
অর্থাৎ মুসলমানদের থেকে পাওয়া অর্থই মুসলিম শাসন অবসান করতে ব্যবহার করেছিলো জগৎশেঠ। এ জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ মীর জাফরের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা নয় বরং হিন্দু মহাজনদের টাকাকেই মূখ্য করেছে। এ সম্পর্কে এক ইংরেজ ঐতিহাসিকরা বলে-The Rupees of the Hindu banker, equally with the sward of the English colonel contributed to the overthrough of the Mahammedan power in Bengla.
উপরের ইংরেজী বক্তব্যে স্পষ্ট লেখা - ‘মুসলমানদের শাসনের পতন ঘটাতে দুটি জিনিস কাজ করেছে - প্রথমত হিন্দুদের টাকা, দ্বিতীয়ত্ব ইংরেজদের তরবারি। এতে বোঝা যাচ্ছে, ঐ সময় ঐতিহাসিকদের কাছে মুসলিম শাসন অবসানের জন্য মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকার খুব একটা মূল্য ছিলো না।
উল্লেখ্য, সিরাজ-উদ-দৌলা পতনের মত ঘটনার গোড়ার ঘটনা হচ্ছে ইংরেজদের কলকাতা দুর্গ নির্মাণ করা। এই দুর্গ নির্মাণকে কেন্দ্র করেই সিরাজের সাথে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব বাধে, যার অনেক পরের ফল হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ। ইতিহাস বলছে, ঐ দুর্গ নির্মাণের মত অর্থ ইংরেজদের ছিলো না, সেই অর্থ কিন্তু দিয়েছিলো রাজবল্লভ।আলীবর্দীর আমলে প্রজাদের সর্বনাশ করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলো সামান্য কেরানী রাজবল্লভ।
সেই টাকা নিজপুত্র কৃষ্ণরায়ের মারফত দুর্গ নির্মাণে পাচার করেছিলো রাজবল্লভ। দুর্গ নির্মাণের পরই কলকাতায় অভিযান চালিয়েছিলো নবাব। এ সময় গ্রেফতার হয় বিশ্বাসঘাতক হলওয়েল, কৃষ্ণদাস ও উমিচাঁদ। কিন্তু সিরাজের অপরাধ ছিলো, সে ঐ তিন বিশ্বাঘাতকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তিনজনকেই ক্ষমা করে দেয়। যার ফল নবাবকে পরে পেতে হয়েছিলো।
এখানে একটা কথা উঠে হিন্দুরা কেন নবাব সিরাজের মূলকেন্দ্র তথা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের পতন চাইবে ?
এর উত্তর হতে পারে, হয়ত মনে মনে মুর্শিদাবাদকে কখনই সহ্য করতে পারতো না হিন্দুরা। কারণ মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী করেছিলো মুর্শিদকুলী খান, যেই মুর্শিদ কুলী খান আগে ছিলো এক কুলীন ব্রাহ্মণ, যে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যায়। এই কারণে মুর্শিদাবাদের উপর ক্ষোভ বা হিংসা ছিলো গোঁড়া হিন্দুদের।
আবার অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, একজন শেঠ (জগৎশেঠ) কিভাবে একজন নবাবকে সরিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করলো
এর উত্তর হচ্ছে, ঐ সময় অর্থকড়ির একটা বড় হিসেব হতো এই শেঠ পরিবারের মাধ্যমে। মুসলিম শাসকদের তোষণ করে তারা সে সুযোগটা আদায় করে নিয়েছিলো। সারা ভারতের বহু স্থানেই তাদের গদি ছিলো। ইংরেজরা শেঠ পরিবারের নাম দিয়েছিলো ‘ব্যাংকার’। বর্তমানে যারা ইহুদীদের রথচাইল্ড পরিবার সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের জন্য বিষয়টি বুঝতে সোজা হবে।
বর্তমানে সারা বিশ্বের শাসক কে হবে, আর কে না হবে, এটা পর্দার আড়াল থেকে মূল চাবিকাঠি নাড়ে রথচাইল্ড পরিবার। এরা টাকার জোরে মূল কাজটি করে থাকে। ঐ সময়ও টাকার জোরে জগৎশেঠ পেছন থেকে বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিলো।
সত্যিই বলতে, ইতিহাস পড়লে একটা স্বল্প শিক্ষিত লোকও বুঝতে পারবে বাংলার শাসন অবসানে মীর জাফর ছিলো একটা পুতুল মাত্র। কারণ তাকে সিংহাসনে বসানোর পর তার কোন ক্ষমতা ছিলো না, তাকে যা বলা হতো সে তাই করতো। তাও মাত্র ৩ বছরের মাথায় তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর বসানো হয় মীরকাশেমকে। দেখা গেলো মীরকাশেম যখন জগৎশেঠের বিরুদ্ধে গেলো, তখনই ইংরেজরাই মীরকাশেমের বিরুদ্ধচারণ শুরু করলো। এর দ্বারা প্রমাণ হয় মীরজাফর ও মীরকাশেমের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক, ইংরেজ ও জগৎশেঠ তথা হিন্দুদের সাথে সম্পর্কের তুলনায় কিছুই ছিলো না।
মীরজাফর কে ছিলেন
আপনারা সবাই মীরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক জানেন, আসলে কে এই মীরজাফর চলুন জেনে নেওয়া যাক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার তাবেদার নবাব, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌলার সাথে ইস্ট ইন্ডিজ'র লর্ড ক্লাইভের সাথে যুদ্ধের সময়, সিরাজউদৌলার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। এই সূত্রে যে কোন বিশ্বাস ঘাতককে বাংলা ভাষায় 'মীরজাফর' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মীরজাফর এর পুরো নাম মীর জাফর আলী খান। ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মীরজাফর নবাব সিরাজউদৌলার একজন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও সিরাজউদ্দৌলার বিপক্ষেই কাজ করেছেন।
১৭৫৭ সালে ২৩ জুন। নদীয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান বাহাদুর নবাবের নির্দেশ উপেক্ষা করে ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ নেননি।
ফলে, যুদ্ধে পালাতে হয়েছিল সিরাজউদ্দৌলাকে। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে ব্রিটিশদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ভারত বর্ষে। ফলে মীর জাফরকে ইতিহাস ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবকে পরাজিত করা এবং হত্যাকে ইতিহাস ‘কলঙ্কজনক’ অধ্যায় বলেও চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে আজ তা অমোচনীয়।
ব্রিটিশদের আশীর্বাদে নবাব হিসাবে জায়গা পেলেও মীর জাফর আলি খান বাহাদুর, পলাশীর যুদ্ধের ৯ বছর পর ১৭৬৫ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
মীরজাফরের বংশধরেরা এখন যেভাবে বেঁচে আছেন
আপনারা সবাই জানেন, প্রাচীন ভারতে বাংলা বিহার ওড়িশার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মীরজাফর সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এই সূত্রে যে কোন বিশ্বাসঘাতককে বাংলা ভাষায় 'মীরজাফর' হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর সেই মীরজাফরের বংশধররা আছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে।
মীরজাফরের বংশধরদের একজন, রেজা আলি মির্জা। তবে তিনি মির্জা পদবি ব্যবহার করেন না। মীরজাফরের হাজারদুয়ারি প্যালেসেও থাকেন না। কারণ এ বাসার গেটেই স্থানীয়রা লিখে দিয়েছে ‘ নেমকহারাম’ গেট। মানুষ আসা যাওয়ার পথে থুথু ফেলে।
ফলে রেজা আলি , অনেকের কাছে পরিচিত জাফর আলি রেজা তিনি লালবাগ এলাকায় দোতলা বাসা বানিয়ে বসবাস করছেন মীরজাফরের পরিচয় গোপন করে। তিনি শিক্ষকতা করতেন। মানুষ ভালো। স্থানীয় কবি সলিল ঘোষের মতে, তার মতো মানুষ হয় না। তবুও পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের দায়ে তাকে পরিচয় গোপন করে চলতে হয়।
তবে রেজা আলির ছেলে মীর জাফরের নবম বংশধর ফাহিম জানান, এলাকার লোকজন তাদের কোন ধরনের বিরক্ত করে না-কারণ এলাকার সবাই জানেন মীর জাফরের বিষয়টা নিয়ে আসলে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাছাড়া কেউ এখনো জানেনা আসলে পলাশীর যুদ্ধে কি হয়েছিল। এমন ও হতে পারে, তখন ইংরেজরা কোন না কোনভাবে মীর জাফরকে বাধ্য করেছিল যার জন্য সে এভাবে বেইমানি করতে বাধ্য হয়েছিলো।
আপনি মুখে যা ই বলুন আসল ঘটনা ,মীরজাফরের বংশধরেরা নিজেদের বংশ পরিচয় দিতে চান না সহজে। তিনি এমএ পাশ করে চাকরি খুঁজছেন। মোদি সরকারের আমলে চাকরি পাবেন বলে মনে করেন না ফাহিমের বন্ধু তারিক। তাই ফাহিম অন্যত্র চলে গিয়ে ব্যবসার চিন্তা করছেন।
বেশ কিছুদিন আগে মীরজাফরের অষ্টম বংশধর, মানে ফাহিমের বাবা অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক রেজা আলি তার বাড়িতে থাকা বিভিন্ন দলিল, প্রমাণাদি ইত্যাদি একত্রিত করে একটা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘ মীর জাফর বেইমান নয়!’
এই বই প্রকাশের পরপরেই পুরো মিডিয়া এবং ভারত জুড়ে তোলপাড় লেগে যায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি এই বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হোন।
রেজা আলির বাল্যবন্ধু সলিল ঘোষ বলেন, তাদের দোষ তো একটাই, তারা মীরজাফরের বংশে জন্মগ্রহণ করেছে। এছাড়া তো তাদের আর কোন দোষ নেই, তারা তো পলাশীর যুদ্ধও করেনি, নবাব সিরাজউদ্দোলার সাথে বেইমানিও করেনি। কিন্তু তবুও তাদেরকে সমাজে আজও ঘৃণিত হয়ে থাকতে হচ্ছে, এটা অন্যায়।
উপসংহার
নানা নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুতে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে মসনদে বসেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নবাব দেখেন চারিদিকে দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্ত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাস্ত হন। ফলে ১৯০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
অতএব, আশা করছি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ, পলাশীর যুদ্ধ কোথায় সংঘটিত হয়েছিল এবং পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন কেন এ সমস্ত বিষয়গুলো এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url