আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছি যারা আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস জানার জন্য ইউটিউব ও ফেসবুকে সার্চ করে থাকি। অনেকে বিভিন্ন রকম ভাবে ভুলভাল তথ্য দেওয়ার কারণে আপনারা বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। আজকে আমি আপনাদেরকে আখেরি চাহার শোম্বা কী,

আখেরি-চাহার-শোম্বার-ইতিহাসআখেরি চাহার শোম্বা কত তারিখ পালিত হয় ও আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং সঠিক সময় জানিয়ে দেব। তাহলে চলুন জেনে নিই আখেরি চাহার শোম্বা ২০২৪ সালের কতো তারিখে পালিত হবে ও আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস আখেরি চাহার শোম্বা কীঃ-

পেইজ সূচিপত্রঃ আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস

আখেরি চাহার শোম্বা কী

আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস আখেরি চাহার শোম্বা কী, আখেরি চাহার শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ আখেরি যার অর্থ হলো শেষ, ফার্সি চাহার শব্দের অর্থ হলো সফর মাস এবং ফার্সি শোম্বা শব্দের অর্থ হলো বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহার শোম্বার অর্থ দাঁড়ায় সফর মাসের শেষ বুধবার। সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে ওঠার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই আখেরি চাহার শোম্বা।
আরও পড়ুনঃ
আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র জীবনের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ আর সমস্ত আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, গতি-বিধি, পদক্ষেপ, সময়-ক্ষণ তথা সমগ্র জীবনই উত্তম আদর্শের অনুপম নিদর্শন। যা কোরআন শরীফে নানা আঙ্গিকে ব্যক্ত হয়েছে। তবে মক্কায় তার নবুওয়্যাত- রেসালত জীবনের ১৩টি বছরই তাঁকে মক্কার কাফের কোরাইশদের নানামুখী কঠোর নির্যাতন নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। হিজরতের পর মদীনায় আগমনের পরও রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদী-মোনাফেকদের নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

মক্কার কাফেররা তাকে, মদীনার ইহুদী মোনাফেকদের যোগ সাজশে স্বস্তিতে-শান্তিতে থাকতে দেয়নি এবং তারা সর্বদা আগ্রাসী ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকে এমনকি বহু রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করে এবং সর্বক্ষেত্রেই ওরা শোচনীয় পরাজয় করে। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ওরা মহানবী (সা.) এর প্রাণনাশের পর্যন্ত অপচেষ্টা চালাতে থাকে। মোনাফেক ইহুদী চক্র বিধর্মীরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারে যে, ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করা সম্ভব নয়।

১। প্রশ্নঃ আখেরি চাহার সোম্বা কখন পালিত হয়?

উত্তরঃ ফারসি ভাষায় আখেরী অর্থ শেষ, আর 'চাহার শোম্বা' অর্থ বুধবার। অর্থাৎ হিজরি সনের সফর মাসের শেষ বুধবারকেই আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। এ দিনে নবিজি (স.) শেষ বারের মতো রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করেছিলেন বলে প্রতি বছর মুসলমানরা শুকরিয়ার দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে থাকেন।

২।প্রশ্নঃ আখেরী চাহার শোম্বা গোসল কি?

উত্তরঃ কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের আলোকে 'আখেরি চাহার শোম্বা' পালন করা হয়; যদিও ধর্ম-তত্ত্ববিদগণের মধ্যে এই দিবসটি পালন করা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। দিবসটি মূলত 'শুকরিয়া দিবস' হিসাবে পালিত হয়; যাতে সাধারণত গোসল করে দু'রাকাত শোকরানা-নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে মুক্তির দোয়া ও দান-খয়রাত করা হয়।

৩।প্রশ্নঃ আখেরি চাহার সোম্বা ২০২৪ কত তারিখ?

উত্তরঃ বাংলাদেশের আকাশে গতকাল কোথাও ১৪৪৬ হিজরি সনের পবিত্র সফর মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে আজ মঙ্গলবার পবিত্র মহররম মাস ৩০ দিন পূর্ণ হবে এবং আগামী ৭ আগস্ট বুধবার থেকে পবিত্র সফর মাস গণনা করা হবে। সেই হিসেবে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হবে।

৪। প্রশ্নঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের ৫ দিন পূর্বে কত মশক পানি দিয়ে গোসল করেন?

উত্তরঃ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াবী হায়াতের শেষ বুধবার ৭ মশক পানি দ্বারা গোসল করেছেন এবং সুস্থতা অনুভব করে মসজিদে নববী শরীফে প্রবেশ করেছেন এবং খুতবা বয়ান প্রদান করেছেন।

৫। প্রশ্নঃ আখেরি চাহার শোম্বা কি ছুটির দিন?

উত্তরঃ আখেরি চাহার শোম্বা একটি ঐচ্ছিক ছুটি দিন। বাংলাদেশ আখেরি চাহার শোম্বা সরকারি ছুটি দিন হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। এই দিনে বাংলাদেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি ব্যাংক সব কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকে।

আখেরি চাহার শোম্বা কত তারিখ

আপনাদের মধ্যে অনেকেই জানতে চান আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস, আখেরি চাহার শোম্বা ২০২৪ সালের কতো তারিখে পালিত হবে। অনেকেই বিভিন্ন রকম ভাবে ভুলভাল তথ্য দেওয়ার কারণে আপনারা বিভ্রান্ত হন। আজকে আমি আপনাদেরকে সঠিক তথ্য এবং সঠিক সময় জানিয়ে দেব। তাহলে চলুন জেনে নিই আখেরি চাহার শোম্বা ২০২৪ সালের কতো তারিখে পালিত হবে।

আমরা জানি যে মুসলিম ধর্ম-মতে ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে আরবি মাস গণনা করে। চলতি বছর ২০২৪ সালের ৭ ই আগস্ট থেকে আরবি সফর মাস শুরু হয়েছে। সেই অনুযায়ী আরবি ২৭ সফর, ১৪৪৫ হিজরী, ইংরেজি ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বুধবার পালিত হবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা। আখেরি চাহার শোম্বা একটি ঐচ্ছিক ছুটি দিন। বাংলাদেশ আখেরি চাহার সোম্বা সরকারি ছুটি দিন হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। এই দিনে বাংলাদেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি ব্যাংক সব কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকে।

আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস

আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস হলো রাসুল (সাঃ) ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ দিকে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ২৮ সফর বুধবার তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এই দিন কিছুটা সুস্থবোধ করায় তিনি গোসল করেন এবং শেষবারের মতো নামাজে ইমামতি করেন। মদিনাবাসী এই খবরে জানতে পেরে দলে দলে এসে উনাকে দেখতে আসেন।
আরও পড়ুনঃ
এ বিষয়ে প্রচলিত রয়েছে যে এক ইহুদি কবিরাজ রাসুল (সা.)-এর চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করে গোসল করেন। ফলে সব মুসলমান খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। সবাই সাধ্যমতো দান-সদকা করেন।শুকরিয়ার নামাজ আদায় ও দোয়া করেন। কেউ কেউ দাস মুক্ত করে দেন। অবশ্য বিকেলেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর সুস্থতায় আর উন্নতি হয়নি, তিনি আর গোসলও করেননি। পরে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ইন্তেকাল করেন।

তাই অনেকেই সফর মাসের আখেরি চাহার শোম্বা বা শেষ বুধবারকে ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বিভিন্ন দরবার শরিফে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। শোকরানা-নফল নামাজ আদায় করা হয়। রোগমুক্তির দোয়া করা হয়। দান-খয়রাত করা হয়। সফর মাসের শেষ বুধবার, এই দিনে রাসুলে পাক (ﷺ) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা লাভ করেছিলেন। এই দিনটাকে আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। সাহাবায়ে কেরামগণ এই দিনটাকে শোকরিয়াতান পালন করতেন। এই দিনে সুবহে সাদিকের পর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত যে কোন সময়ে গোসল করলে অনেক ফযিলত। সারা বছর অনেক রোগ-ব্যাধি থেকে আল্লাহ তায়ালা হিফাযত করেন।

সফর মাস আরবী হিজরি মাসের ২য় মাস। আর মাহে সফরের শেষ বুধবারকে ইসলামী পরিভাষায় মুসলিম সমাজে আখেরী চার শোম্বা হিসেবে বুঝায়। যেহেতু এক সময়ে ফার্সী ভাষা প্রচলিত ছিল আর ফার্সী ভাষায় বুধবারকে চার শোম্বাহ বলা হয়। মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবারকে গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। এর পেছনে যে প্রেক্ষাপট রয়েছে তা হলো ‘দুনিয়াবী সকল বাতিল অপশক্তি প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়ে ইহুদীগণ হুযূর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে যাদু করেছিল। কিন্তু তাদের যাদু শক্তি প্রিয়নবীর মধ্যে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অবশেষে ৭ম হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মহররম মাসে মদিনায় ইহুদী নেতৃবৃন্দ লবীদ ইবনে আসম ইয়াহুদীকে বলল, তুমি ও তোমার কন্যাগণ তো যাদু বিদ্যায় পারদর্শী।

সুতরাং মুসলমানের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ধবংস ও ক্ষতি সাধনের জন্য যাদু করো। লবীদ কৌশলে প্রিয় রাসূলের এক ইহুদী গোলামের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার ব্যবহৃত চিরুনীর ভাঙ্গা দাঁত ও চুল মোবারক সংগ্রহ করে নিলো। তারপর মোমের একটা পুতুল তৈরি করে তাতে এগারোটি সুঁচ ঢুকিয়ে দিল। একটি সুতায় ১১টি গিরা দিলো। এসব কিছু ওই পুতুলের ভেতর স্থাপন করে প্রবহমান কূপের পানির ভিতর একটা পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রেখে দিলো। এর প্রভাবের ফলে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ চল্লিশ রাত বা ছয় মাস অথবা এক বছরকাল শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

অতঃপর জিব্রাইল আমীন আলায়হিস্ সালাম সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস এ দুটি সূরা প্রিয় নবীর উপর নাজিল/অবতীর্ণ করলেন। আর এ দু’টি সূরা মিলে আয়াত সংখ্যা হয় ১১টি। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ দেয়া হল। আল্লাহর হাবীব হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে উক্ত কূপে পাঠিয়ে ছিলেন, তিনি কূপের পানি ফেলে দিয়ে যাদুর সব সমগ্রী পাথরের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসলেন। হুজুর আলায়হিস্ সালাম এ সূরা ২টি পাঠ করলেন প্রতিটি আয়াত পাঠের সদকায় একেকটি করে গিরা খুলে গেল।

ফলে আল্লাহর প্রিয় হাবীব হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরোগ্য লাভ করলেন এবং গোসল করলেন। ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন সে দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বা হিসেবে স্মরণ করা হয়। বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিন রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং গোসল করেন। এ দিনের পর তিনি আর গোসল করেননি। এরপর তাঁর রোগ বৃদ্ধি পায় অতঃপর ১২ রবিউল আউয়াল ওফাত লাভ করেন।

এ দিন মুসলমানরা গোসল করে, নতুন পোশাক পরিধান করে এবং খোশবু লাগায়। তৎকালীন দিল্লির বাদশাহী কেল্লায় এ উৎসব উপলক্ষে বিশেষ দরবার বসত। এতে শাহজাদা ও আমিররা শরিক হতেন (ফারহাঙ্গ-ই-আসফিয়া, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৬)। মুসলমানরা মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে গোসল করেছিলেন তাই উদযাপন করে থাকে। ইসলামী শরিয়তে এ গোসলের তাৎপর্য ও ফযিলত আলোচনার অবকাশ থেকে যায়।

আখেরি চাহার শোম্বা এমন একটি দিন যে দিনের সকালে ছিল আনন্দ আর বিকালে ছিল বিষাদের ছায়া। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই দিন সকালে সুস্থতা বোধ করে গোসল করেন আর দুপুরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সহিহ হাদিসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থকালীন অবস্থা, কর্মোপদেশ এবং তাঁর ইন্তেকালের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরি সনের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি./৭৬৮ খ্রি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অসুস্থতায় ইন্তেকাল করেন সে অসুস্থতা শুরু হয়েছিল সফর মাসের কয়েক রাত বাকি থাকতে। (আস সিরাহ আন নববীয়্যাহ : ইবনু হিশাম)।

বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও ১২ রবিউল আউয়াল মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সূত্রে ইন্তেকালের এ তারিখটি বর্ণিত হয়েছে। আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এটিকেই শুদ্ধতম রেওয়ায়েত বলে ফতোয়া দিয়েছেন। কারণ হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) নবী পরিবারের এমন এক সদস্য যিনি অসুস্থতাকালীন, অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে যাতায়াতকালীন, ইন্তেকাল পরবর্তী গোসলকালীন এমনকি কবরে শায়িত করার সময়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবতে ছিলেন। কাজেই হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-এর কথাই অগ্রগণ্য।

সফর মাসের শেষ বুধবার। সকাল বেলায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা-কে ডেকে বললেন, আয়েশা! আমার জ্বর কমে গেছে, আমাকে গোসল করিয়ে দাও। সে মতে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গোসল করানো হল। আসাহহূস সিয়ারের বর্ণনায় বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘আমার ওপর সাত মশক পানি বইয়ে দাও, যার রিবাত যেন ঢিলা না হয়- অর্থাৎ মশক যেন পূর্ণ হয়, এমন যেন না হয় তা থেকে কিছু পানি পড়ে গেছে। রাহমাতুল্লিল আলামিন গ্রন্থে আছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাথরের জলাধারে বসে সাতটি কুয়ার সাত মশক পানি নিজের মাথায় ঢালিয়ে নেন। এটিই ছিল হুযূরের দুনিয়ার শেষ গোসল। অতঃপর তিনি সুস্থবোধ করলেন।

গোসল সেরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা ও নাতিদ্বয় রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা-কে ডেকে এনে সবাইকে নিয়ে সকালের নাস্তা করলেন। হযরত বেলাল (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) এবং সুফফাবাসী সাহাবিরা এ সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে মদিনার ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিলেন। স্রোতের মতো সাহাবিরা হুযূরের দর্শনের জন্য ভিড় জমাতে লাগল। মদিনার অলিতে-গলিতে আনন্দের ঢেউ লেগে গেল। ঘরে ঘরে শুরু হল সদকা, খয়রাত, দান-সাখাওয়াত ও শুকরিয়া জ্ঞাপন।

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) খুশিতে ৫০০০ দিরহাম ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। হযরত ওমর ফারুক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) দান করলেন ৭০০০ দিরহাম, হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) দান করলেন ৩০০০ দিরহাম। মদিনার ধনাঢ্য মুহাজির সাহাবি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) খুশিতে আল্লাহর রাস্তায় ১০০ উট দান করে দিলেন। হুজুরের একটু আরামের বিনিময়ে সাহাবায়ে কেরামের জানমাল কোরবানি দেয়ার বিষয়টি আজ আমাদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়।

আমাদের দেশে এদিন অনেক মুসলমানই বিশেষ দোয়া চুবানো পানি দিয়ে গোসল করেন এবং আয়াতে শিফা তথা কোরআনুল করিমের ‘সালাম’ সম্বোধিত সাত আয়াত লিখে সেগুলো পানীয় জলে চুবিয়ে পান করেন। অনেকে সূর্যোদয়ের আগে গোসল করেন এবং সূর্যোদয়ের পর দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে নেন। আমলটি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত।

কেউ কেউ একে বেদায়াত ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। মাওলানা আবদুল হাই লক্ষৌনভী তার মাজমুয়ায়ে ফতোয়া কিতাবে ওই পদ্ধতিতে গোসলের মাধ্যমে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘জাওয়াহেরুল কুনুজ’ কিতাবের ৫ম খণ্ডের ৬১৬ পৃষ্ঠার বরাতে স্বীয় রচিত ‘ফতোয়ায়ে আজিজীতে উল্লেখ করেন সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল করা উত্তম। আর সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা ভাল ও সওয়াবের কাজ।

মাহে সফরের শেষ বুধবার সাতটি আয়াতে সালাম লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানিটুকু পান করা উত্তম ও শেফা। সুতরাং মাহে সফরের শেষ বুধবার নফল নামাজ, দোয়া-দরুদ পড়া, কলা পাতায়/কাগজে আয়াতে শেফাসমূহ লিখে গোসল করা এবং আয়াতে সালামসমূহ লিখে পানিতে দিয়ে তা পান করা ভাল ও উত্তম আমল। এতে শরীয়তের দৃষ্টিতে বাধা নেই।

তাজকিরাতুল আওরাদ’ কিতাবে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি আখেরি চার শম্বাহ্ তথা মাহে সফরের শেষ বুধবারে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের পর আয়াতে রহমত (সাত সালাম বিশিষ্ট আয়াতে করিমা) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দেবে বা তা পানের উপর লিখে ধুয়ে পানি পান করবে আল্লাহ্ পাক তাকে সব রকম বালা-মুসিবত ও রোগ-ব্যাধি হতে নিরাপদে রাখবেন। আনওয়ারুল আউলিয়া কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি আখেরী চাহার শোম্বা-এর দিন দু’রাকাত নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ্ তাকে হৃদয়ের প্রশান্তি দান করবেন। তদুপরি ‘আর রাহিকুল মাখতুম্’ আরবী সীরাত গ্রন্থে সফিউর রহমান মোবারকপুরী বর্ণনা করেন:

ويوم الاربعاء قبل خمسة ايام من الوفاة اثقلت حرارة العلة فى بدنه فاشتد به الوجع وغمى فقال هريقوا علّى سبع قرب من ابارتشى حتى اخرج الى الناس فاعهد اليهم فافعدوه فى مخضب وصبوا عليه الماء حتى طفق يقوله حسبكم حسبكم وعند ذالك احس بخفةٍ فدخل المسجد وهو معصوب الرأس حتى جلس على المنبر وخطب الناس والناس مجتمعون حوله الخــ الرحيق المختوم لصفى الرحمن المباركفورى ـ الصف ……….৪৬৫

অর্থাৎ হুজুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল শরীফের পাঁচদিন পূর্বে (প্রিয় নবীর দুনিয়াবী হায়াতের শেষ বুধবারে (চার শম্বাহ্ দিবসে) প্রিয় নবীর নূরানী শরীর মোবারকের উত্তাপ অত্যন্ত বেড়ে গেল। এতে তাঁর কষ্ট বেশী হয়ে গেল। বেঁহুশের মত হয়ে গেলেন। এ সময় তিনি বললেন, তোমরা বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি আমার উপর ঢাল, যাতে আমি সাহাবায়ে কেরামের নিকট যেতে পারি এবং প্রতিশ্র“তি নিতে পারি।

অতঃপর উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে (প্রিয় রাসূলকে) বসালেন এবং তাঁরা তাঁর শরীর মোবারকে পানি প্রবাহিত করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, যথেষ্ট, যথেষ্ট। তিনি সুস্থতা বোধ করলেন এবং মসজিদে নববী শরীফে মাথা মোবারকে পট্টি বাঁধাবস্থায় তাশরীফ নিলেন, তারপর মিম্বর শরীফে বসে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে বক্তব্য পেশ করলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম তাঁর চতুর্পার্শে সমবেত ছিলেন।

উপরোক্ত বর্ণনা মতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াবী হায়াতের শেষ বুধবার সাত মশক পানি দ্বারা গোসল করেছেন এবং সুস্থতা অনুভব করে মসজিদে নববী শরীফে প্রবেশ করেছেন এবং খুতবা (বয়ান) প্রদান করেছেন।

এক্ষেত্রে হযরত আয়শা সিদ্দিকার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা) একটি হাদিস স্মরণযোগ্য। মা আয়েশা সিদ্দিকা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা) বলেন. ইন্তেকালের আগে যখন তাঁর রোগ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায় তখন আমি সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে তাঁর দু’হাতে ফুঁক দিতাম। অতঃপর তিনি নিজে তা সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিতেন। আমার হাত তাঁর পবিত্র হাতের বিকল্প হতে পারত না। তাই আমি এরকম করতাম (ইবনে কাসির)। তাছাড়া কোরআনুল করিম মুমিনদের জন্য শিফা উল্লেখ করে ক্বোরআনুল করিমে বলা হয়েছে, ওয়ানুনাজজিলু মিনাল কুরআনি মা হূয়া শিফাউ ওয়ারাহমাতুল লিল মু’মিনীন।

তাই বালা-মুসিবত, রোগ-শোক থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাইতে মুসলিম সমাজ এ দিবসটি গোসল ও দোয়া দরূদের মাধ্যমে ভাল ও উত্তমপন্থা হিসেবে পালন করে থাকে।

আখেরি চাহার শোম্বা পালন ও উৎযাপন

আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয় শুকরিয়া দিবস হিসেবে হিজরি সনের সফর মাসের শেষ বুধবার মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয়।মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনে আখেরি চাহার শোম্বা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের পূর্ববর্তী সময়ে এই দিনটিতে কিছুটা সুস্থতা বোধ করেছিলেন।

ফারসিতে এ দিনটিকে আখেরি চাহার শোম্বা নামে অভিহিত করা হয়। আগেই বলেছি, ফারসি শব্দমালা আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনে তাঁর পার্থিব জীবনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন বলে দিনটিকে মুসলমানরা প্রতিবছর ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন। তারা নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দিবসটি অতিবাহিত করেন। উম্মতে মুহাম্মদির আধ্যাত্মিক জীবনে আখেরি চাহার শোম্বার গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম।

ধর্ম-তত্ত্ববিদগণের মধ্যে এই দিবসটি পালন করা নিয়ে মতভেদ থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের আলোকে এই দিবস পালন করা হয়। দিবসটি মূলত ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালিত হয়; যাতে সাধারণত গোসল করে দু’রাকাত শোকরানা-নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে মুক্তির দোয়া ও দান-খয়রাত করা হয়। বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবার, খানকায় ওয়াজ-নসিহত, জিকির-আজকার, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় এই দিনটি পালন উপলক্ষে। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ রাখার পাশাপাশি অফিস-আদালতে ঐচ্ছিকভাবে ছুটির দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়

আখেরি চাহার শোম্বা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট একটি গল্প

হিজরি ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস সফর। আমাদের সমাজে সফর মাসকে কেন্দ্র করে অনেক কুসংস্কার, কুপ্রথা ও বিদআত প্রচলিত রয়েছে। যার মধ্যে আখেরি চাহার সোম্বা নামক ভিত্তিহীন একটি বিদআত অন্যতম। উক্ত দিবসকে কেন্দ্র করে যে গল্পটি প্রচলিত তা মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতে ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যাচার বৈ কিছু নয়। আজকের এই লেখায় কথিত আখেরি চাহার সোম্বা ও সফর মাসের অন্যান্য কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা সম্পর্কে জানব ইনশাআল্লাহ।
আখেরি-চাহার-শোম্বা-ভিত্তিহীন-ও-বানোয়াট-একটি-গল্প
আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস আখেরি চাহার শোম্বা কী আমাদের দেশের মুসলিম সমাজে মকসুদুল মুমিনীন, বারো চান্দের ফজিলত ইত্যাদি অনির্ভরযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য কিছু বই প্রচলিত রয়েছে। এ ধরনের বইপুস্তকে ইসলামের নামে বিভিন্ন রেওয়াজ-রসম বর্ণনা করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নাই। আখেরি চাহার সোম্বা বিষয়ে মকসুদুল মুমিনীন টাইপের কিছু বইতে যে বানোয়াট গল্পটি লিখা হয় তা অনেকটা নিম্নরূপ:

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সফর মাসের শেষে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সফর মাসের শেষ বুধবারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানিকটা সুস্থতা বোধ করেন এবং এই দিনে ৭ মশক পানি দ্বারা গোসল করেন। উক্ত রোগমুক্তির ঘটনায় সাহাবীগণ যারপরনাই আনন্দিত হন এবং বিশেষ দোয়া, মুনাজাত, ইবাদত করেন। সকল সাহাবী প্রচুর দান সাদাকাহ করেন।
আরও পড়ুনঃ
হযরত উসমান রা. তাঁর খামারের ৭০ টি উট জবাই করে গরীবদের মাঝে বিলি করেন। হযরত আবু বকর রা. ৭ হাজার দিনার, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা. ৫ হাজার দিনার, হযরত ওসমান রা. ১০ হাজার দিনার, হযরত আলী রা. ৩ হাজার দিনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করেন। এরপর থেকে মুসলিমগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করে উক্ত দিনে দান-সাদাকাহ করে আসছেন।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। এরপর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করতে পারেন নি। তাই সকল মুসলিমের জন্য এই দিনে ওজু-গোসল করে ইবাদত বন্দেগি করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করে সওয়াব রেছানী করা উচিত।

উক্ত গল্পটির কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি বা প্রমাণ হাদীস শরীফের বিশাল ভাণ্ডারে পাওয়া যায় না। কতিপয় অসতর্ক বক্তা বানোয়াট এ গল্পটি বিভিন্ন ওয়াজে-বক্তব্যে প্রচার করেছেন। এর কোনো ভিত্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীস অথবা সাহাবীগণের কোনো হাদীস অথবা তাবেয়ী-তাবে তাবেয়ীগণের কোনো বক্তব্যে বিশুদ্ধ সূত্রে পাওয়া যায় না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে অনেকবার রোগমুক্তি ও বিপদমুক্তির ঘটনা ঘটেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ইহুদির জাদু থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। হিজরতের মতো একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর রহমতে নিরাপদে মদীনায় পৌঁছেছেন। বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেছেন। এরকম অসংখ্য বিপদমুক্তির ঘটনা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে রয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তিকালের পরে কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী-তাবে তাবেয়ী উক্ত বিপদমুক্তির দিবসগুলো বছর বছর পালন করেছেন? হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে এমন নজির পাওয়া যায় না।

কথিত আখেরি চাহার সোম্বা নিয়ে কত গল্প ও কত আমল আমাদের সমাজে প্রচলিত। সরকারিভাবে এই দিন উদযাপন করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দিন উপলক্ষে বিশেষ ছুটি দেয়া হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত মনগড়া ও বানোয়াট দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে বিশেষ “মিলাদ মাহফিল” এর আয়োজন করা হয়।

প্রতিটি পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিশেষ অনুষ্ঠান ও ফিচার প্রকাশ করা হয়। কেউ কেউ উক্ত দিনের ঘটনা বর্ণনা করে লম্বা ওয়াজ-নসিহত করেন। ইউটিউবে শত শত ভিডিও রয়েছে এই দিবস কেন্দ্রিক। অনেকগুলো ভিডিও এমন ব্যক্তিদের, যাদের নামের সঙ্গে শোভা পায় “মাওলানা”, “ডক্টর”, “মাদরাসার অধ্যক্ষ” ইত্যাদি শব্দ। দুঃখজনক হলেও সত্য, উক্ত বক্তাগণ আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেন। কিন্তু আখেরি চাহার সোম্বা বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য হাদীসও তারা উল্লেখ করতে পারেন না।

আল্লাহ তাআলা এরকম অজ্ঞতা ও ভ্রান্তি থেকে আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।

আখেরি চাহার শোম্বার নামাজ ও অন্যান্য বিদআত আমল

সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ দিনে কোনোরূপ ইবাদত, নামাজ, রোজা, যিকির, দোয়া, দান, সাদাকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনো সাওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। তাযকিরাতুল আখেরাত, মকছুদুল মুমিনীন, বারো চান্দের আমল এজাতীয় কিছু বইয়ে আখেরি চাহার সোম্বার বিশেষ নামাজ ও কিছু বিশেষ আমলের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কথিত আখেরী চাহার সোম্বার নামাজের নিয়ম হিসাবে বলা হয়ে থাকে- সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর ২ রাকাত নামাজ পড়তে হবে। সে নামাজের উভয় রাকাতে সূরা ইখলাস ১১ বার করে পড়তে হবে এবং নামাজ শেষে ৭০ বার বিশেষ দরূদ ও দোয়া পড়তে হবে। সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল নামাজ বিশেষ কিছু সুরা, আয়াত ও দোয়া পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এছাড়াও আখেরি চাহার সোম্বার দিন বিশেষ দোয়া পড়ে পানিতে ভিজিয়ে পান করা ও সেই পানি দিয়ে গোসল করার একটি রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। এটিও মনগড়া, বানোয়াট একটি রেওয়াজ।

সফর মাসকে অশুভ ও বালা মুসিবতের মাস মনে করা একটি জাহেলি কুসংস্কার

আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস কোনো স্থান, সময়, বস্তু বা কর্মকে অশুভ বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামি বিশ্বাসের পরিপন্থি একটি কুসংস্কার। আরবের মানুষরা জাহেলি যুগ থেকে ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এই ভুল ধারণা খণ্ডন করেছেন। হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لاَ عَدْوَى وَلاَ صَفَرَ وَلاَ هَامَةَ

অর্থ : রোগের কোনো সংক্রমন নেই, সফরের কোনো কুলক্ষণ নেই, পেঁচার মধ্যেও কোনো কুলক্ষণ নেই। [সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭১৭]

আরেক হাদীসে আছে, জাহিলী যুগে লোকেরা সফর মাসকে অমঙ্গলের মাস হিসাবে বিবেচনা করত, এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : না, সফর মাস এরূপ নয়। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৯১৫]

অথচ এরপরও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার থেকে যায়। শুধু তাই নয়, এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেওয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা বানিয়ে হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করছেন অসতর্ক কতিপয় বক্তা।

তারা জালিয়াতি করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বলছেন, এই মাস বালা মুসিবতের মাস। এই মাসে এত লক্ষ এত হাজার বালা নাযিল হয়। এই মাসেই আদম আলাইহিস সালাম ফল খেয়েছিলেন। এ মাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহ আলাইহিস সালামের কওম ধ্বংস হয়। এ মাসেই ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে ফেলা হয়। এ মাসের আগমনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যথিত হতেন। এই মাস চলে গেলে খুশি হতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব। এরকম অনেক কথা তারা বানিয়েছে।

আর অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান তাদের এ সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করেছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা মুসিবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।

সফর মাসের ১ম রাতের নামাজ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট আমল

সফর মাসের জন্য কোনো বিশেষ নামাযও নেই, রোযাও নেই। এই মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে বিশেষ কোনো প্রকারের নামায আদাযের বিশেষ সওযাব বা ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। অনুরূপভাবে এই মাসের কোনো দিনে রোযা পালনেরও কোনো বিশেষ ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। এই মাসকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে।

উপরোক্ত মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীন ‘নামাজের’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাতে মাগরিবের পরে বা ইশার পর চার রাকাত নামাজ আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত এত পুরস্কার পাবে ইত্যাদি। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যাক্তি চার রাকা’আত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ মানুষ এগুলি বিশ্বাস করেছেন এবং কেউ কেউ নিজেদের বইয়ে ও ওয়াজে উল্লেখ করেছেন।

আখেরি চাহার শোম্বা সফর মাসের শেষ বুধবার

আখেরি চাহার শোম্বা সফর মাসের শেষ বুধবার বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যেকোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এই দিনে সবচেয়ে বেশী বালা মুসীবত নাযিল হয়। এই সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ বুজুর্গ বিশ্বাস করেছেন।

সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাজিল্ হয় এবং সবদিনের চেয়ে বেশী আখেরী চাহার শম্বা(সফর মাসের শেষ বুধবার) তে নাযিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকআত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ঐ বালা হতে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাঁকে হেফাজত রাখবেন। [খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার, রাহাতিল কুলুব- পৃষ্ঠা ১৩৯] এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোন প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। এই দিনে ইবাদত, বন্দেগী, সালাত, সিয়াম, জিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য দিনের চেয়ে বেশী বা বিশেষ কোন সওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারনা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সর্ব প্রকার বিদ’আত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।

সফর মাসের ফজিলত ও আমল

সফর মাস কেন্দ্রীক বিশেষ কোনো ফজিলত সম্বলিত হাদীস পাওয়া যায় না। সফর মাস উপলক্ষ্যে বিশেষ কোনো আমলের বর্ণনাও কোনো গ্রহনযোগ্য বিশুদ্ধ হাদীস থেকে পাওয়া যায় না। তাই আমরা সফর মাসের জন্য স্পেশাল কোনো আমল বা ফজিলতের ব্যাপারে বিশ্বাস রাখব না। সফর মাসকে অশুভ বা বালা-মুসিবতের মাস হিসাবে যেই কুসংস্কার আছে সেগুলোও বিশ্বাস করব না।
সফর-মাসের-ফজিলত-ও-আমল
অন্যান্য মাসে যে সকল সাধারন আমল রয়েছে সফর মাসেও সেগুলো করার চেষ্টা করব। যে আমলগুলো জেনারেল, যেগুলো সকল মাসেই করণীয় সেগুলো আমরা এ মাসেও করব।

যেমনঃ-
  • অন্যান্য মাসের মত সফর মাসেও আমরা আইয়ামে বীজের ৩ টি নফল রোজা রাখব।
  • সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার চেষ্টা করব।
  • নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ব ইনশাআল্লাহ।
  • ঘুমাতে যাওয়ার আগের আমল সহ সকল কাজে সুন্নাহ এর অনুসরণ করব।
  • সালাতুদ দুহা সহ অন্যান্য সুন্নত ও নফল নামাজের আমল করব। 
  • এছাড়াও সফর মাস সহ সকল মাসের জুমআর দিনে বিশেষ কিছু আমল করব।
আরও পড়ুনঃ
তবে মনে রাখতে হবে যে, এই আমলগুলো মোটেও সফর মাসের বিশেষ আমল নয়। বরং অন্যান্য সকল মাসের জন্য এই আমলগুলোর যেই ফজিলত ও সওয়াব, সফর মাসের জন্যও সেই একই ফজিলত ও সওয়াব। কোনো আমলকেই সফর মাসের জন্য খাস বা বিশেষায়িত মনে করব না।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস আমরা জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোন প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। এই দিনে ইবাদত, বন্দেগী, সালাত, সিয়াম, জিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য দিনের চেয়ে বেশী বা বিশেষ কোন সওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারনা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।

অতএব, আশা করছি আখেরি চাহার শোম্বা কী আখেরি চাহার শোম্বার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সর্ব প্রকার বিদ'আত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url