শবে বরাতের নামাযের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল এবং আল্লাহ তাআলা কোরআন ও হদিসের মাধ্যমে যে বার্তা পাঠিেছেন তা আমি আজকের এই আর্টিকেলে বর্ণনা করব। শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) হলো পবিত্র শবে বরাতের রাত।
এই রাতে মহান আল্লাহ মুক্তি ও মাগফিরাতের দুয়ার খুলে দেন। সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এটি নিঃসন্দেহে বরকতময় রাত। রাতটি শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত হিসেবে হাদিসে এই রাতকে লাইলাতুল নিসফি মিন শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়েছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে।
শবে বরাতের নামাযের নিয়ম কি, কতো রাকাত ও কীভাবে পড়তে হয় অনেকেই জানতে চান। সাধারণত শবে বরাতের নামায নফল নামায। তাই এই নামায আর অন্য নামাযের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই রাত্রির নামাযে ভিন্ন কোনো পদ্ধতি মহানবী (সাঃ) অবলম্বন করেননি। স্বাভাবিক নিয়মে দুই রাকাত নফল নামাযের নিয়ত করে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আপনি যতটুকু পারেন পড়তে পারেন।
শবে বরাত বা লায়লাতুল বরাতের নামায শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে পড়তে হয়। এশার নামাযের পর হতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বেতেরের নামাযের পূর্বে পড়তে হয়। নামায, কোরআন তিলাওয়াত, যিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, ইস্তিগফার ইত্যাদি নফল ইবাদতের মাধ্যমে সারারাত অতিবাহিত করলে অসংখ্য নেকী পাওয়া যায় এবং সমস্ত গুনাহ মাফ হয়।
এছাড়াও এ রাতে পড়তে পারেন ‘সালাতুল তাসবীহ এর নামায। এই নামাযের অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন নামাজ হলো উত্তম ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন। এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন।
এদিন এশার নামাযের পর হতে হায়াতের বরকত, ঈমানের হেফাযত এবং অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়ার জন্য দুই রাকাত করে মোট ৬ রাকাত নফল নামায পড়া উত্তম। এশার জামাতের পর সারারাত দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করা যায়। আর জীবনে কাজা হয়ে যাওয়া নামাযগুলো আদায়ের সুযোগ রয়েছে এই রাতে।
শবে বরাতের নামাযের নিয়ম ও নফল নামায
দুই রাকাত তহিয়াতুল অজুর নামাযের নিয়মঃ প্রতি রাকাতে আল হামদুলিল্লাহ (সূরা ফাতিহা) পড়ার পর ১ বার আয়াতুল কুরসি এবং তিন বার ক্বুলহু আল্লাহ (সূরা এখলাছ) পড়া। ফজিলতঃ প্রতি ফোটা পানির বদলে সাতশত নেকী লিখা হবে।
দুই রাকাত নফল নামাযের নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসি এবং ১৫ বার করে সূরা এখলাছ পড়া, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর ১২ বার দুরূদ শরীফ পড়া। ফজিলতঃ রুজিতে বরকত, দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে, গুনাহ হতে মাগফিরাতের বকশিস পাওয়া যাবে।
আট রাকাত নফল নামায দু’রাকাত করে পড়তে হবে, নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর, সূরা এখলাছ ৫ বার করে পড়া। একই নিয়মে বাকি সব রাকাত। ফজিলতঃ গুনাহ থেকে পাক হবে, দুআ কবুল হবে এবং বেশি বেশি নেকী পাওয়া যাবে।
১২ রাকাত নফল নামায দু’রাকাত করে, নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর, ১০ বার সূরা এখলাছ এবং এই নিয়মে বাকি নামাজ শেষ করে, ১০ বার কালেমা তওহীদ, ১০ বার কলেমা তামজীদ এবং ১০ বার দুরূদ শরীফ পড়া।
১৪ রাকাত নফল নামায দু’রাকাত করে, নিয়মঃ প্রতি রাকাত সূরা ফাতিহার পর যে কোন একটি সূরা পড়ুন। ফজিলতঃ যে কোনো দু’আ চাইলে তা কবুল হবে।
চার রাকাত নফল নামায এক সালামে পড়তে হবে, নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পর ৫০ বার সূরা এখলাছ শরীফ পড়া। ফজিলতঃ গুনাহ থেকে এমনভাবে পাক হবে যেন সদ্য মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
আট রাকাত নফল নামায এক সালামে, নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১ বার সূরা এখলাছ শরীফ পড়া। ফজিলতঃ এর ফজিলতে সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, হযরতে সৈয়্যদাতুনা ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা এরশাদ করেছেন, ‘আমি ওই নামাজ আদায় কারীর সাফায়াত করা ব্যতীত জান্নাতে কদম রাখব না।
শবে বরাতের নামাযের নিয়ত
শবে বরাতের নামাযের নিয়ত আরবি ও বাংলা দুই ভাবেই করা যায়। শবে বরাতের রাতে নফল নামায হিসেবে দুই রাকাত দুই রাকাত করে ইচ্ছেমত আপনি নামায আদায় করতে পারেন। এক্ষেত্রে নামাযের পূর্বে অবশ্যই নিয়ত করতে হবে। নিয়ত ছাড়া কখনোই নামায আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হবে না। নামায আদায় করার পূর্বে আরবিতে অথবা বাংলাতে নিয়ত পড়লেই হবে। এক্ষেত্রে আরবি অথবা বাংলা নিয়ত কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাকবীর ”আল্লাহু আকবার” বলা।
শবে বরাতের নামাযের বাংলা নিয়তঃ যারা আরবিতে নিয়ত করতে জানেন না তারা বাংলাতে নিয়ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে যেভাবে আপনি বাংলাতে নিয়ত করবেন তা হচ্ছে-
আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিবলামুখী হয়ে শবে বরাতের দুই রাকাত নফল নামায আদায়ের নিয়ত করছি, আল্লাহু আকবর। আর যারা এ কথাটিও বলতে পারবে না তারা শুধুমাত্র আল্লাহু আকবার বলে নামাজের নিয়তে দাঁড়িয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ নামাজ হয়ে যাবে।
শবে বরাতের রাতের দোয়া
শবে বরাতের রাতে একজন মুসলিম যেসব ইবাদত করবেন তার পুরোটাই নফল। এ রাতে কোরআন
তিলাওয়াত, জিকির, নামাজ সব নফল। কোনোটাই ফরজ, ওয়াজিব বা অন্ততপক্ষে সুন্নতে
মুয়াক্কাদাও নয়। এজন্য কেউ এ রাতে নফল নামাজ পড়লে তা অন্যান্য যেকোনো সময়ের নফল নামাজের
মতো পড়বে, নফল নামাজে সানা, সূরা ফাতিহা, সূরা মিলানো, বৈঠক, তাশাহুদ,
দরুদ, দোয়া মাসুরা, সব স্বাভাবিক নিয়মে পালন করতে হবে।
নামাজ শেষে চাইলে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে পারেন। তবে এ রাতের নফল
নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে আলাদা কোনো দোয়া নেই। তাই শবে বরাতে কারো জন্য
নির্দিষ্ট কোনো দোয়া করা উচিত হবে। তবে রজব ও শাবান মাসে আল্লাহর রাসূল
বরকত চেয়ে আল্লাহর কাছে যে দোয়াটি করেছেন চাইলে তা পড়া যেতে পারে। দোয়াটি
হলো-
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান
পর্যন্ত পৌঁছে দিন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রজব মাস শুরু হলে রাসুল
(সঃ) এই দোয়া পাঠ করতেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিসঃ ২৫৯)
তবে
এ রাতে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। কদরের রাত্রিতে
একটা দোয়া পড়া হয় ক্ষমা লাভ করার জন্য। এ দোয়াটা এ রাতেও পড়া যায়।
গুরুত্বপূর্ণ দোয়াটি হলোঃ
অর্থঃ হে
আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা পছন্দ করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও। এ
ছাড়াও এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ পাঠ পর দিন রোজা রাখার অনেক
অনেক ফজিলত রয়েছে।
শবে
বরাত ইসলামে এই রাত বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। শিরক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া
সবারই ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এই রাতে। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল
(রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে
অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন
এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে
হিব্বান: ৫৬৬৫)
হাদিসের বর্ণনামতে, মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারীরা এই
রাতে ক্ষমা পাবে না। তাই এই রাতের ফজিলত লাভের জন্য প্রথমে অতীতের সব
গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিক তওবা করা উচিত হবে। একইসঙ্গে শিরক ও
হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এছাড়াও এই
রাতে আরও কিছু দোয়া করা যায়। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়াঃ শবে বরাতে এই দোয়াটি পাঠ করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এই রাতে আল্লাহ
তাআলার ক্ষমা পেতে হলে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তাই যেকোনো
মর্যাদাপূর্ণ রাতে নিচের দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার দোয়াটি হলো- رَبَّنَا
اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا
تَجْعَلْ فِىْ قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ
رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
উচ্চারণ:
রব্বানাগফির লানা- ওয়া লিইখ্ওয়া-নিনাল্লাযীনা সাবাকূনা- বিল ঈমা-নি ওয়ালা-
তাজ‘আল ফী কুলূবিনা- গিল্লাল লিল্লাযীনা আ-মানূ রব্বানা- ইন্নাকা রাঊফুর
রহীম। অর্থঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও আমাদের পূর্ববর্তী ভাইয়েরা যারা
ঈমান এনেছে তাদের ক্ষমা কর, ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ
রেখো না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ালু পরম করুণাময়’। (সুরা হাশর: ১০)
শিরক থেকে মুক্ত থাকার দোয়াঃ আল্লাহর কাছে যেকোনো দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত শিরক থেকে বেঁচে
থাকা। আর শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করতে হয়।
রাসুল (সঃ) সেই উপায় শিখিয়ে দিয়েছেন। মা’কাল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) বলেন,
আল্লাহর রাসুল (সঃ) আবু বকর (রাঃ)-কে বলেছেন, হে আবু বকর! নিশ্চয় তোমাদের
মাঝে শিরক পিপীলিকার পদধ্বনির চেয়ে সূক্ষ্ম। সেই সত্তার শপথ— যার হাতে আমার
প্রাণ, শিরক পিপীলিকার পদধ্বনির চেয়ে সূক্ষ্ম।
আমি
কি তোমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব না, যা বললে শিরকের অল্প ও বেশি সবই দূর
হয়ে যাবে? আপনি বলুন— ااَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ اَنْ أشْرِكَ بِكَ
وَاَنَا أَعْلَمُ وَاَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন-আশরিকা বিকা, ওয়া আনা আ’লামু; ওয়া
আসতাগফিরুকা লিমা লা আ’লামু। ’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি সজ্ঞানে তোমার সঙ্গে
শিরক করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই এবং যা আমার অজ্ঞাত তা থেকেও তোমার
কাছে ক্ষমা চাই। (সহিহ আল আদাবুল মুফরাদ: ৫৫১) রমজানপূর্ববর্তী বিশেষ দোয়াঃ রমজানের দুই মাস আগ থেকেই রাসুল (স.) উম্মতকে একটি দোয়া বেশি বেশি পড়ার
নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দোয়াটি আমরা পুরো রজব-শাবানে তো পড়বোই। আজ শবে বরাতের
রাতেও আমরা দোয়াটি পড়ব ইনশাআল্লাহ। দোয়াটি হলো— اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا
فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা
বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান। ’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ,
আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। ’
(বায়হাকি: ৩৫৩৪; নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬)
মা-বাবাসহ সকল মুসলমানের জন্য দোয়াঃ হিংসুক কখনও অন্যের জন্য দোয়া করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত মুমিনরা
পৃথিবীর সব মুসলমানকে মনে-প্রাণে ভাই মনে করেন এবং সবার জন্য দোয়া করেন।
পবিত্র কোরআনে জীবিত-মৃত সব মুসলমানের জন্য দোয়ার শিক্ষা রয়েছে। তেমনই একটি
দোয়া হলো— রব্বানাগ-ফিরলি ওয়ালি ওয়ালি-দাইয়্যা ওয়ালিল মু’মিনিনা ইয়াওমা
ইয়াকুমুল হিসাব। অর্থঃ হে আমাদের রব! আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং সব
ঈমানদারকে আপনি সেই দিন ক্ষমা করে দিন, যেদিন হিসাব কায়েম করা হবে। (সুরা
ইবরাহিম: ৪১)
জীবিত-মৃত পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য দোয়া করার আরও উপকার আছে। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, প্রত্যেক মুসলমানের বিপরীতে একটি করে সওয়াব মহান আল্লাহ তার আমলনামায় লিখে দেন।
আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের দোয়াঃশবে বরাত আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভের রাত। এই রাতে আল্লার অনুগ্রহ চেয়ে এই দোয়া পড়া যায়— رَبِّ أَوْزِعْنِىٓ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِىٓ أَنْعَمْتَ عَلَىَّ وَعَلٰى وٰلِدَىَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صٰلِحًا تَرْضٰىهُ وَأَدْخِلْنِى بِرَحْمَتِكَ فِى عِبَادِكَ الصّٰلِحِينَ উচ্চারণঃ রাব্বি আওঝি’নি আন আশকুরা নি’মাতাকাল্লাতি আনআমতা আলাইয়্যা ওয়া আলা ওয়ালিদাইয়্যা ওয়া আন আ’মালা সালেহাং তারদাহু ওয়া আদখিলনি বিরাহমাতিকা ফি ইবাদিকাস সালিহিন। অর্থ: হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্য আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দাও। আর আমি যাতে এমন সৎকাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ করো। আর তোমার অনুগ্রহে তুমি আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো। (সুরা নামল: ১৯)
শবে বরাত রাতের ইবাদত সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে, ১৫ই শা'বান অর্থাৎ, শবে বরাতের সন্ধ্যায়-গোসল করা মোস্তাহাব। যদি কেউ ইবাদত মনে করে গোসল করে, তার শরীরে ছিটকানো প্রত্যেক পানির ফোঁটার পরিবর্তে তার ‘আমলনামায় ৭০০ শ' রাক'আত নফল নামাযের সওয়াব লেখা হবে। অতঃপর তাহিয়াতুল অজুর দুই রাকআত নামায আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতেহার পর একবার আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস তিনবার পড়ে নামায শেষ করবে।
এরপর আরো ৮ রাকআত নফল নামায পড়বে। প্রত্যেক দুই রাক'আতে সূরা ফাতেহার পর একবার সূরা ‘ইন্না আন্জালনা' ও কোনো কোনো আলেমের মতে, এই রাতে বেশি পরিমাণে নফল নামায, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির আজকার ও আপন গুনাহ্ মাফের জন্য কান্নাকাটি এবং দুনিয়ার সকল মুর্দাদের কবরের আযাব, রূহের শান্তির জন্য ও জান্নাত নছীব হওয়ার জন্য দু'আ করবে।
এ রাতে আপনজনের কবর জেয়ারত করবে। সাধ্য অনুযায়ী দান-সদকা করবে। বেশি পরিমাণে দরূদ শরীফ পড়বে। রাত জেগে নিজের অতীত গুনাহ্ ও কৃতকর্মের কথা চিন্তা করে আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটি করবে। শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ ও ১৫ ই শা'বান রোযা রাখবে। ইমাম গায্যালী (রঃ) তার সুবিখ্যাত কিতাবে লিখেছেন, নবী করীম (সাঃ) শা'বান মাসে এতো বেশি রোযা রাখতেন, মনে হতো এটা যেন রমজান মাস।
শবে-বরাত রাত জেগে নফল নামায ও অন্যান্য ইবাদত করার কারণে যদি কারো ফজরের নামায কাযা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার জন্য উত্তম হলো, ইশার নামায জামা'আতে পড়ে সামান্য কিছু নফল ইবাদত করে ঘুমিয়ে পড়া এবং ফজরের জামা'আতে হাজির হওয়া। কেনো না, হযরত উসমান (রাঃ) রেওয়ায়েত করেছেন, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজরের নামায জামা'আতের সঙ্গে আদায় করল, সে যেন সারা রাত জেগে নফল ইবাদত করল।
আর যদি সারা রাত জেগে নফল ইবাদত করার কারণে ফজরের নামাযের কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে ইবাদত করাই উত্তম।
শবে বরাত রাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল
শবে বরাত রাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল। শবে
বরাত বা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরি শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত যা
গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলোর মধ্যে একটি। এই রাতকে ভাগ্যরজনি বলা হয়ে থাকে। হাদিস
শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদত
করতেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু আমল দ্বারা বিশেষ
কিছু ইবাদত প্রমাণিত হয় যা তিনি করেছেন। সে আলোকে এ রাতের কিছু
গুরুত্বপূর্ণ আমল তুলে ধরা হলো-
নফল নামাজ পড়াঃ এ রাতে দীর্ঘ
(কেরাতে) তেলাওয়াতে নফল নামাজ পড়া। অর্ধ শাবানের রাতে রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক পরিমাণে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়তেন।
কোরআন তেলাওয়াত, জিকিরঃ বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, জিকির-আজকারে মশগুল থাকা।
দোয়া করাঃ নিসফা শাবানের রাতের দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। তাই বেশি বেশি দোয়া করতে পারেন।
তাওবা
ও ইসতেগফার করাঃ বান্দার গুনাহ মাফে তওবাহ করার বিকল্প নেই। বান্দা নিজের
গুনাহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে তা থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে
ক্ষমা প্রার্থনা করা। তবে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।
রোজা
রাখাঃ নিসফা শাবানের রাতের পরের দিন রোজা রাখা। হাদিসে এসেছে- হজরত আলি
রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন, যখন শাবান মাসের ১৫তম রাত তোমাদের সামনে এসে যায় তখন তোমরা
সে রাতে নামাজ পড় এবং পরবর্তী দিনে রোজা রাখ।' (ইবনে মাজাহ)
শবে বরাতেও যাদের পাপ ক্ষমা হবে না
এই রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের দিকে মনোযোগী হন। আর মনোযোগী হয়ে বান্দাদের বিভিন্ন ভাষায় ডাকেন। কোনো ক্ষমাপ্রত্যাশী ব্যক্তি আছে কি, তাকে আমি ক্ষমা করে দেব। কোনো অনুগ্রহ কামনাকারী ব্যক্তি আছে কি, তাকে আমি অনুগ্রহ করব। কোনো রিযিকের প্রত্যাশী ব্যক্তি আছে কি, তাকে আমি রিযিক দেব, কোনো অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি, তাকে সুস্থতা দেব, মুক্ত করে দেব। তাই আমাদের উচিত এই রাতে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য প্রার্থনা করা।
শবে বরাতে যারা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা, দয়া, রিজিক ইত্যাদি চাইবে তাদের চাওয়া পূরণ করা হবে।কিন্তু তিন শ্রেণীর মানুষ ছাড়া আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা ও দয়া করেন। ১. শিরককারী বা মুশরিক, যার জীবনে শিরক রয়েছে। ২. মুশাহিন, মানে হিংসুক। ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্টকারী।
১। শিরককারীঃ প্রথম ব্যক্তি হল ‘মুশরিক’। তাকে আল্লাহ আজ রাতে রহমত দিয়ে আচ্ছাদিত করবেন না। ইসলাম ধর্মে, শির্ক পৌত্তলিকতা বা বহুঈশ্বরবাদ চর্চা করার পাপকে বুঝায় অর্থাৎ শির্ক হল আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে সাব্যস্ত করা বা তার উপাসনা করা। শাব্দিকভাবে এর দ্বারা এক বা একাধিক কোন কিছুকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বের অংশীদার সাব্যস্ত করাকে বুঝায়। আল্লাহর নামের সাথে শিরক করে, আল্লাহ ইবাদতে শিরক করে, আল্লাহ সিজদার মধ্যে শিরক করে এবং শিরকের যত প্রকার হতে পারে ছোট, বড়, প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সব ধরনের শিরককারীকে মুশরিক বলা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাত্রে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।
কাজেই অন্তর থেকে শিরক ও যাবতীয় কুসংস্কারকে দূর করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনিই আমার সিজদা পাওয়ার উপযুক্ত।আল্লাহই দোয়া শুনবেন। আল্লাহই আমার দোয়া কবুল করবেন। আল্লাহই বান্দাকে রহমত করতে পারেন। রিজিক (জীবনোপকরণ) দেন, শুধুমাত্র আল্লাহই মানুষকে সন্তান দিতে পারেন। এ পূর্ণ বিশ্বাসের নাম হচ্ছে ঈমান, তাওহীদ ও একত্ববাদ। আর এর বিপরীতের নাম শিরক।
২। মুশাহিনঃ অন্যের সুখ, শান্তি ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস করে নিজে এর মালিক হওয়ার বাসনাকে আরবিতে হাসাদ বা হিংসা বলা হয়। ইসলাম অন্যের প্রতি হিংসা করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। হিংসা-বিদ্বেষ এক ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। সম্পদের মোহ ও পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের ভালো কাজকে নষ্ট করে ফেলে। তাই নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।
৩। আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্টকারীঃ দ্বিতীয় ব্যক্তি যার গোনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না, যার তাওবা কবুল করবেন না, তাকে রহমত করবেন না, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদকারী। যাদের সাথে কোন ভাইয়ের সম্পর্ক, বোনের সম্পর্ক নেই, মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করেছে, অন্যায় করেছে, ফুফুর সাথে সম্পর্ক নেই, খালার সাথে সম্পর্ক নেই, মামার সাথে সম্পর্ক নেই, রক্তের আত্মীয়-স্বজনের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নষ্ট করেছে, আজকের এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের গোনাহকে মাফ করবেন না।
তাদের দোয়া কবুল করবেন না। তাদেরকে রহমত করবেন না। কারো ভাইয়ের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, বোনের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, মা-বাবার সাথে যদি কখনো বেয়াদবি হয়ে থাকে, তাহলে এখনই ক্ষমা চেয়ে তার পর আল্লাহর রহমত চাইতে হবে, এর আগে যদি আল্লাহর রহমত চাওয়া হয় আল্লাহ রহমত করবেন না। বিশেষ করে মা-বাবার ব্যাপারেও হাদীসে বিশেষ সতর্ক বাণী উচ্চারিত হয়েছে।
অন্য হাদীসে আছে, এ রাতে যারা মা-বাবার সাথে কোন বেয়াদবি করেছে মা-বাবার অন্তরে আঘাত দিয়েছে, কথায় কষ্ট দিয়েছে, কাজে কষ্ট দিয়েছে, সামর্থ থাকা সত্তেও মা-বাবার জন্য ব্যয় করেনি, মা-বাবার অসুস্থ থাকা অবস্থায় তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাতে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। যাদের মা-বাবা এখন দুনিয়াতে নেই, ক্ষমা চাওয়ার মত উপায় নেই তাদের পরিত্রানের উপায় হল তাদের কবর যিয়ারত করা, তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে তাওবা এবং দোয়া করা।
শবে বরাতের রাতে কি কি আমল করবেন
শবে বরাতের রাতে কি কি আমল করবেন জেনে নিন, শবে বরাত ফারসি ভাষার শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত। আর ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য। আরবিতে একে লাইলাতুল বরাত বা সৌভাগ্য রজনী বলা হয়। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী,শবে বরাত বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ রাত। মহান আল্লাহ এ রাতে বান্দাদের গুনাহ মাফ করে দেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।
শবে বরাত উপলক্ষে রাসুলে আকরাম (সাঃ) দুটি জিনিস করার জন্য বলেছেন। ১. রাত জেগে আল্লাহর কাছে ইবাদত করা। যেমন–নফল নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, তাসবিহ পাঠ করা। দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি পাঠ করা। ২. রোজা রাখা, নবী কারিম (সাঃ) গোটা শাবান মাস রোজা রাখতেন। তাই এ মাসে আমরা যত বেশি পারি রোজা রাখবো ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে আল্লাহর রসুল সা. বলেছেন, قوموا ليلها وصوموا نهارها এই রাত জেগে ইবাদত করো আর দিনে রোজা রাখো। শবে বরাতের রাতে কি কি আমল করবেন জেনে নিন-
১. ফরজ নামাজ জামায়াত আদায় করাঃ সেহরী খেয়ে ফজরের নামায মসজিদে এসে জামাত আদায় করার চেষ্টা করর, কারণ হাদীসে এসেছে- ক) হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি জামায়াতের সাথে এশার নামাজ আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত কিয়াম (ইবাদত) করল। আর যে ফজরের নামাজ জামায়াতসহ আদায় করল, সে যেন সারা রাত নামাজ পড়ল।
তিরমিযির বর্ণনায় উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এশার নামাজের জামায়াতে হাযির হবে, তার জন্য অর্ধ-রাত পর্যন্ত কিয়াম করার নেকি হবে। আর যে এশাসহ ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়বে, তার জন্য সারা রাত ব্যাপী কিয়াম করার সমান নেকি হবে। (মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, আহমদ, মুওয়াত্তা মালিক)
আবু উমামা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করলো, সে যেন হজ্জ করে আসলো। আর যে ব্যক্তি নফল নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেলো, সে যেন ওমরাহ করে আসলো। (তাবারানি) কাজেই এশা এবং ফজরের নামাযকে প্রথম তাকবীরের সাথে আদায় করার চেষ্টা করতে হবে।
২. আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করাঃ আমরা এ রাতে ঘরে কিংবা মসজিদে নীরব জায়াগায় আল্লাহ দরবারে দুই হাত তুলে কান্না করব। কারণ এ রাত হচ্ছে কান্নার রাত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে ক্ষমা করে দেন। আর আমি যেন এ লক্ষ মানুষের বাইরে না থাকি। আল্লাহ রহমতের চাদরে যেন আমি অন্তর্ভূক্ত থাকি। চাদরের বাইরে যেন আমার স্থান না হয়।
এ জন্য আল্লাহর দরবারে ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। বুক ফেটে কাঁদতে হবে। যার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হবে একমাত্র আল্লাহকে রাযি করার জন্য, কাউকে দেখানোর জন্য নয়। হাদীসে আছে মশার ডানা পরিমান অর্থাৎ এক কণা চোখ দিয়ে যদি পানি বের হয়ে ঝরে পড়ে যায় তাহলে সে চোখকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। অর্থাৎ সে লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন। আসুন আমরা কাঁদি আল্লাহর দরবারে কাঁদি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তুমি যদি মাফ না কর তাহলে মাফের কোন উপায় নেই।
৩. ইস্তেগফার করাঃ হে আল্লাহ অনেক গোনাহ করেছি, সে গোনাহ থেকে আমরা ক্ষমা চাই এটাকে বলা হয় ইস্তেগফার। বার বার করতে থাকব। কারণ এটা তাওবার রাত, গোনাহ মাফ চাওয়ার রাত। কুরআনে করীম যদি আপনি পড়ে দেখেন বারবার আপনি পাবেন তওবার কথা। মানে হচ্ছে যারা তওবা করে, আল্লাহর দরবারে ফিরে আসে। হে আমার বান্দা আস ফিরে আস। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি এ গোনাহ করেছি আর করবো না।
(ক) এ গোনাহর জন্য আমি অনুতপ্ত। (খ) আমি বর্তমানে এ গোনাহকে ছেড়ে দিয়েছি। (গ) আমি ভবিষ্যতে আর এ গোনাহ করবো না। এটিকে বলা হয় তাওবা। এ তিন জিনিস যদি হয় তাহলে এটাই হবে খাঁটি তাওবা। এমন যদি হয়, আমি বলছি, হে আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করে দাও কিন্তু যে গুনাহ করলাম সে গোনাহের জন্য কোন অনুতপ্ত হলাম না, সে গোনাহ এখনো আমি করছি, ভবিষ্যতে ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এভাবে মানুষ যখন তাওবা করে তখন আল্লাহ ক্ষুদ্ধ হন। খাঁটি তাওবাকে শয়তান ভয় করে।
বর্ণিত আছে, এক বুযুর্গ স্বপ্নে শয়তানকে দেখলেন। শয়তান খুবই ব্যস্ত ও চিন্তিত। জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার তুমি এত চিন্তিত? সে বলল আমি আল্লাহর একজন বান্দাকে অনেক কষ্টের মাধ্যমে একটি পাপ করাই, করার পর সে অনুতপ্ত হয়, সে আবার তাওবা করে ফেলে। আমি এক সপ্তাহ চেষ্টা করে তার মাধ্যমে একটি গোনাহ করালাম, তাওবা করার মাধ্যমে সে যেন আমার কোমরে একটি লাথি দেয়। কারণ আমি তার মাধ্যমে যে গোনাহ করালাম তাওবার কারণে সে গোনাহ মাফ হয়ে গেল। এত কষ্ট নিমিষেই সে নষ্ট করে দিল। এ জন্য আমি চাই যে লোকেরা তাওবা না করুক।
৪. কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করাঃ হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যদি কেউ আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করার ইচ্ছা করে, তাহলে সে যেন আল-কোরআন তিলাওয়াত করে।’ নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করে, সে একটি নেকি পায়, আর প্রত্যেকটি নেকি ১০টি নেকির সমান। (তিরমিজি)
শবে বরাতে সুন্দরভাবে শুদ্ধ করে কুরআন তেলওয়াত করতে হবে। বিশেষ করে সূরা ইয়াসিন তিনবার, সূরা দুখান তিনবার, সূরা আর-রাহমান, সূরা ওয়াকেয়া, সূরা মূলক ইত্যাদি তেলাওয়াত করতে পারেন। যখন জান্নাতের কথা আসবে ‘জান্নাত’ শব্দ আসবে তখন আল্লাহ তা’আলার কাছে ফরিয়াদ করব, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে জান্নাতের অধিকারী করে দাও। আর যখন জাহান্নাম শব্দ আসবে তখনও আল্লাহর কাছে বলব, হে আল্লাহ তুমি আমাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দাও। এভাবে কুরআন করীমের তেলাওয়াত করব। ৫. দিনে রোযা পালন করাঃ শা’বান মাসের ১৫ তারিখের রোযার অনেক ফযিলত রয়েছে। যে কেউ এ রোযা রাখবে মহান রব তার পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। রোযার ফযীলত রাসূল সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে শাবানে ১ দিন রোযা রেখেছে, তাকে আমার সাফা’য়াত হবে। আরো একটি হাদীস শরীফে আছে যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখবে, তাকে জাহান্নামের আগুন ছোঁবে না।
হযরত আলী (রাঃ) হতে মারফু মুত্তাছিল সনদে রেওয়ায়েত করেন- যে, আল্লাহর হাবীব নবী করিম (সাঃ) এরশাদ ফরমান- যখন শাবানের ১৫ তারিখের রাত্র আগমন করে তখন তোমরা রাত্র জাগরণ করতঃ মহান আল্লাহ তা‘য়ালার এবাদত বন্দেগী কর এবং এর পূর্ববর্তী দিনে (১৫ তারিখে) রোজা পালন কর। (ইবনে মাজাহ) শাবান মাসে আল্লাহর রাসূল সবচেয়ে বেশি রোযা রাখতেন, বিশেষ করে মধ্য শাবান ১৫ তারিখের রোজা রাখার কথা হাদীস দ্বারা প্রমানিত।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ছয় রাকাত নামাজ আদায় করবে; এসবের মাঝে কোনো মন্দ কথা না বলে, তার এই নামাজ ১২ বছরের ইবাদতের সমতুল্য গণ্য হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি মাগরিবের পর বিশ রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। (তিরমিজি, মিশকাত, ফয়জুল কালাম)।
৬. বেশী বেশী নফল নামাজ আদায় করাঃ এ রজনিতে অধিক হারে নফল নামায আদায় করার জন্য চেষ্টা করব। দু’রাকাত নফল নামায যদি আল্লাহ তা’আলার দরবারে কবুল হয় আমরা জান্নাতে যাওয়ার জন্য সে দু’রাকাআতই যথেষ্ট হয়ে যাবে। বোখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীস-অর্থাৎ এমনভাবে তুমি এবাদত করবে আল্লাহকে যেন তুমি দেখছো। অতটুকু যেতে না পারলেও অন্তত মনে করবে যেন আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।
আমি আল্লাহ তা’আলার দরবারে দাঁড়িয়েছি শুরু থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত পুরা দু’রাকাআত নামাযে যদি আমার এ মনোভাব থাকে অবশ্যই তিনি আমাদের নামায কবুল করবেন। বৎসরের প্রতি রাতেইতো আমরা ঘুমাচ্ছি। অন্তত কয়েকটি রাত, শা’বানের মধ্য রাত, কদরের রাত এবং দু’ঈদের রাত জাগ্রত থেকে পূর্ণরাত এবাদত করে আল্লাহর দরবারে যদি কাটিয়ে দিই তাহলে আমাদের কোন ক্ষতি হবেনা। কাজেই পুরারাত আমরা এবাদত করার চেষ্টা করব।
৭. বেশী বেশী দরুদ শরীফ পড়াঃ বেশি করে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ শরীফ পাঠ করব। একবার যে ব্যক্তি আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ওপর দশটি রহমত নাযিল করবেন। যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পড়া হয়না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেন না। এজন্য দোয়ার শুরুতেও দুরুদ পাঠ করতে হবে এবং শেষেও দুরুদ পাঠ করতে হবে।
৮. তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করাঃ যারা অসুস্থ কিংবা দুর্বল পুরা রাত এবাদত করার সুযোগ হবেনা, তারা তাড়াতাড়ি শুয়ে ভোর রাতে উঠে যাবে। যাতে তাহজ্জুদ নামায আদায় করা যায়। কারণ তাহাজ্জুদের সময় দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়। বিশেষ করে মধ্য শাবানের এ রাতে তাহাজ্জুদ যেন কারো ছুটে না যায়। রাতে যখন পরিবারের সবাই জাগ্রত থাকবে এ রাতে যদি আমি তাহাজ্জুদ পড়তে না পারি আমার চেয়ে পোড়া কপাল আর কে হতে পারে। এজন্য দুর্ভাগা মানুষের তালিকায় যেন আমার নাম অন্তর্ভূক্ত না হয়।
৯. কবর জিয়ারত করাঃ এ রাত্রে আপনজন যারা কবরে তাদের কবর যিয়ারত করবেন। এতে ফয়েজ ও বরকত হাসেল হয়। তবে হ্যাঁ কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সারা রাত্র ব্যয় করে দেওয়াটা বোকামী। যেহেতু সুন্নত আদায়ের লক্ষ্যে আয়ত্বের ভিতরে নিকটতম কবর জিয়ারত করলে আদায় হয়ে যায়। কেনান, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মা আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) শা’বানের ১৫ তারিখের রাতে জান্নাতুল বাকীতে মোনাজাতরত অবস্থায় পেয়েছেন। (জামে তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)
১০. জিকির ও তাসবীহ-তাহলীল পড়াঃ নামাজের পর আল্লাহর জিকির করা। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, দরিদ্র লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল, সম্পদশালী ব্যক্তিরা বেশি সওয়াব এবং জান্নাত নিয়ে যাচ্ছে! আমরা যেমন নামাজ পড়ি; তারাও পড়ে। আমরা যেমন রোজা রাখি তারাও রাখে। উপরন্তু তাদের রয়েছে অতিরিক্ত সম্পদ; ফলে তারা হজ্জ করতে পারে, ওমরাহ করতে পারে, জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সদকাও দিতে পারে।
নবীজি তাদেরকে বললেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল শিখিয়ে দিব না; যা করতে পারলে তোমরা অগ্রগামীদের স্তরে পৌঁছে যাবে এবং যারা তোমাদের পেছনে তারা তোমাদের স্তরে পৌঁছতে পারবে না, তোমরা হবে শ্রেষ্ঠতম মানব, তবে অন্য কেউ এটি করলে সেও তোমাদের মতো হয়ে যাবে। আমলটি হলো, প্রত্যেক নামাজের পর তেত্রিশবার করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। (সহীহ বোখারী: ৮০৭, সহীহ মুসলিম: ১৬৭৪)
হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আমরা একবার রাসূল (সাঃ)-কে বলি, হে আল্লাহর রাসূল! ধনী ব্যক্তিরা সওয়াবের ক্ষেত্রে আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা হজ্জ করেন, আমরা হজ্জ করি না। তারা সংগ্রাম-যুদ্ধে শরিক হন, আমরা শরিক হতে পারি না। আরো আরো। তখন রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন আমালের কথা বলবো যেটা তোমরা করলে তোমরা তারা যে আমল করে তারচেয়ে বেশি সওয়াব পাবে?
আর সেটা হলো- প্রতি নামাজের পর তোমরা ৩৪ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ও ৩৩ আলহামদুল্লিাহ পড়ো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম একজন সাহাবী বর্ণনা করেছেনঃ যে ব্যক্তি সকালে ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় ১০০ বার সুবহানাল্লাহ এর যিকির করবে সে যেন ১০০ বার হজ্জ আদায় করল।
শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয়
এই রাত ফজিলতপূর্ণ এবং ইবাদতের রাত। তবে এ রাতকে ঘিরে আমাদের সমাজে ইবাদত মনে করে বেশ কিছু কাজের প্রচলন রয়েছে ইসলামি শরিয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই। শবে বরাত পুণ্যময় রজনী। এ রাতে কোনো নোংরা ও গর্হিত কাজ করা অনুচিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যা ক্ষতিকর এবং ভীতি সৃষ্টি করে, তা পরিহার করা ইসলামে স্বীকৃত। শবে বরাতে বিশেষ কিছু আমল আছে, যা করলে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। এ রাতের করণীয় ও বর্জনীয় কিছু কাজ রয়েছে তা নিচে দেওয়া হলোঃ
যা যা করা উচিত
(ক) নফল নামাজ, ১. তাহিয়্যাতুল অজু, ২. দুখুলিল মাসজিদ, ৩. আউওয়াবিন, ৪. তাহাজ্জুদ, ৫. ছলাতুত তাসবিহ ৬. তাওবার নামাজ, ৭. ছলাতুল হাজাত, ৮. ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।
(খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা।
(গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা।
(ঘ) কোরআন শরিফ, ১.সুরা দুখান ও ২. অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা।
(ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া।
(চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা।
(ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা।
(জ) কবর জিয়ারত করা।
(ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
যা যা করা উচিত নয়
(১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো।
(২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা।
(৩) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা।
(৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা।
(৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো।
(৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।
শবে বরাতের রজনীতে যাদের দোয়া কবুল হয় না
মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারীরা এই রাতে ক্ষমা পাবে না। তাই এই রাতের ফজিলত
লাভের জন্য প্রথমে অতীতের সব গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিক তওবা করা
উচিত হবে। একইসঙ্গে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া করাও
বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু শবে বরাতের রাতেও নিম্নবর্ণিত লোকদের দোয়া ও আমল খাটি অন্তরে তওবা না করা পর্যন্ত কবুল হয় না।
(১) মুশরিক (২) মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান (৩) আত্মীয়দের সাথে ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া সম্পর্ক ছিন্নকারী (৪) জালিম শাসক ও তাহাদের সহযোগী, (৫) না হক হত্যাকারী (৬) পরনারীগামী (৭) মদ্যপানকারী (৮) ইর্ষাপরায়ণ (৯) নিন্দাকারী (১০) গনক ও রেখা টানিয়া অথবা ফালনামা দেখিয়া ভাগ্য ও ভবিষাৎ শুভাশুভ নির্ধারণকারী (১১) গায়ক ও বাদক (১২) মিথ্যা শপথের সাহায্যে পণ্য বিক্রয়কারী (১৩) পায়ের গিরার নিচে গর্ব সহকারে কাপড় পরিধানকারী (১৪) যাদুকর (১৫) পরস্পর শত্রুতা ভাব পোষণকারী (১৬) কৃপণ (১৭) অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী (১৮) জুয়াড়ি (১৯) দাবা-পাশার খেলোয়াড় (২০) বিদআ’ত প্রচলনকারী (২১) মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী (২২) সুদ দাতা (২৩) সুদ গ্রহিতা (২৪) ঘুষ দাতা ও গ্রহিতা (২৫) সন্ত্রাস ও ফাসাদ সৃষ্টিকারী।
তাই শবে বরাতের পূর্ণ ফযিলত ও শবে বরাতের রাতে দোয়া কবুল হওয়ার জন্য উল্লেখিত কবীরা গুনাহসমূহ থেকে খাঁটি দিলে তওবা করা উচিত। অন্যথায় সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করেও কোনো লাভের আশা করা যায় না।
শবে-বরাতে প্রচলিত বিদ'আত কার্যাবলি
শবে-বরাতে প্রচলিত বিদ'আত কার্যাবলি গুলো হলো শবে-বরাতে হালুয়া-রুটি, খিচুড়ি, শিরনী-শরবত ইত্যাদির যে ব্যবস্থা ও প্রথা চালু আছে তা বিদ্'আত ও কুসংস্কার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাদীসে এ রাতে যেসব বিষয়ের উপর আমল করতে বলা হয়েছে, এর বাইরে যে সব প্রথা পালন করা হয় তা শরী‘আতের বাইরের জিনিস এবং কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। এর ক্ষতিকারক দিকগুলো নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ
১। নবী করীম (সাঃ)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হওয়ার পর তিনি হালুয়া ও শিরনী পাকিয়েছেন (তাই আমরাও করে থাকি)। এ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ কথা বিশ্বাস করা জায়েয হবে না। সাধারণ বিবেচনায়ও তা সম্ভব নয়। কারণ, ওহুদ যুদ্ধ শা'বান মাসে নয় বরং শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।
২। কেউ কেউ বলে, এই দিনে হযরত আমীর হামজা (রাঃ) শাহাদত বরণ করেছিলেন। তাঁরই রূহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে এই দিন হালুয়া-রুটি বিতরণ করা হয়। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। কেনো না, তাঁর শাহাদাতও শাওয়াল মাসে হয়েছিল। শা'বানের মাসে নয়।
৩। অনেক লোকের বিশ্বাস, শবে-বরাত পুণ্যময় রজনীতে আত্মীয়-স্বজনের রূহ ঘরে ঘরে হাজির হয়ে দেখে, তাদের জন্য কেউ কোনো কিছু রান্না করছে কীনা? বলা বাহুল্য, এ জাতীয় গোপন তত্ত্ব সম্পর্কে শরয়ী অকাট্য দলিল ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণ গ্রহণযোগ্য নয়। আর ইসলামী শরীঅতে এর কোনো দলিল নেই।
৪। অনেকের ধারনা শবে-বরাতের পূর্বে যার মৃত্যু হয়েছে, শবে-বরাতে ফাতিহা আদায় না করা পর্যন্ত তা রূহ্ অন্যান্য মৃতের সাথে মিশতে পারবে না। এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা, অলীক। হাদীসে আছে, কারো মৃত্যু হলে তার রূহ সাথে সাথেই তার সমপর্যায়ের লোকের কাছে পৌঁছে যায়। এটা তো কোথাও নেই যে, শবে-বরাত পর্যন্ত রূহ আটকে থাকে।
৫। হালুয়া-রুটি না হলে যেন শবে-বরাতই হলো না। এ রাতে হালুয়া তৈরী করাকে অতীব জরুরী মনে করে লোকজন আকীদাগত ভ্রান্তিতে পতিত হয়। আর এ প্রথাকে ফরয ও ওয়াজিবের চাইতে বেশী গুরুত্ব দিয়ে কার্যগত ভ্রান্তির শিকার হয়। এ উভয় প্রকার ভ্রান্তি যে অত্যন্ত গর্হিত কাজ তা হযরত হাকীমুল উম্মত (রহ) “ইছলাহুর-রুসুম” নামক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন, যা বাংলা ভাষায় অনুবাদও হয়েছে।
নিশ্চিত বিশ্বাস, প্রথা পালন করতে গিয়ে নিয়্যতেও ভ্রান্তি সৃষ্টি হয় বলে অনেক মুহাক্কিক আলেমের মত। বর্তমানে সওয়াব লাভের আশায় হালুয়া রুটি প্রস্তুত করা হয় না; বরং আসল উদ্দেশ্য থাকে, শবে-বরাতে যে ভাবেই হোক তা পালন করতে হবে, নতুবা লোকে মন্দ বলবে। এ নিয়্যতে খরচ করা অপব্যয় ও অহংকার- র-তাই তা পাপ। অনেক সময় প্রথা পালনের জন্য সুদে ঋণ নিতেও দেখা যায়-যা একটা আলাদা গুনাহ।
৬। সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার যোগ্য লোকজন শবে-বরাতে হালুয়া রুটি থেকে বঞ্চিত হয়। অথবা নিম্নমানের শিরনী তৈরী করে তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়। আর ভালো ও ভদ্র শিক্ষিত লোকগুলো শুধু আত্মীয়-স্বজন ও বড়লোক বা ধনী লোকদের বাড়িতে, বাসাতে সন্ধ্যার সময় বা বিকেলে আনা নেয়া করতে থাকে। এ সময় সকলেরই নিয়্যত থাকে যে, অমুক আমার বাসায় শিরনী বা হালুয়া-রুটি পাঠিয়েছে, আমি যদি তার বাসায় কিছু না পাঠাই তাহলে সে কী মনে করবে? আমাদের মান-সম্মানের ব্যাপার তার সামনে আগামী কাল মুখ দেখাবো কীভাবে? কিছু না পাঠালে তারা কী বলবে? মোটকথা এ ক্ষেত্রে ও রিয়া অহংকারের উপস্থিতি সুস্পষ্ট।
৭। কিছু লোক শবে-বরাতের সময় ঘরের বাসন-পত্র পরিবর্তন করা, ঘর লেপা এবং এ রাতে অতিরিক্ত বাতি জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করাকে অভ্যাস পরিণত করে নিয়েছে। এ জাতীয় রুসূম বিজাতীয় রীতির অনুরূপ। আর হাদীসে বিজাতীয়দের অনুকরণকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। হাদীস শরীফে শবে-বরাতের সময় তিনটি কাজ সুন্নাত মনে করাকে সওয়াব ও বরকত লাভের উপায় বলা হয়েছে। যেমনঃ
(ক) পনের তারিখ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দু'আ ও ইস্তিগফার করা। সাথে সাথে গরীব-মিসকীনদের কিছু দান করে সে দানের সওয়াবটুকু ঐ মৃতদের নামে বখশে দিলে আরো ভাল হয়। সেই মুহূর্তে হাতে না থাকলে অন্য সময় গোপনে কিছু দান করে দেবে। তবে প্রচলীত প্রথার অনুকরণ করলে শরী'আতের সীমা লংঘিত হবে।
(খ) রাত জেগে একা একা বা বিনা আমন্ত্রণে জড়ো হয়ে যাওয়া। দু'চার জনের সাথে ইবাদতে মশগুল থাকা।
(গ) শা'বানের ১৫ তারিখ নফল রোযা রাখা। মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ, প্রণেতা শাহ্ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ) বলেনঃ হিন্দুস্থানের অধিকাংশ শহরের লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে কতগুলো প্রথা প্রচলিত আছে যা খুবই জঘন্য বিদ'আত। যেমন, শবে-বরাতে বাতি জ্বালিয়ে তা ঘরের দরজা ও দেয়ালের উপর রাখা এবং তা দ্বারা আত্মগৌরব করা, আর দলবদ্ধ হয়ে আগুন এবং পটকা নিয়ে নানা প্রকার খেলাধুলায় লিপ্ত হওয়া। সম্ভবত ইহা হিন্দুদের দেয়ালী উৎসবে বাতি জ্বালানোর প্রথা হতে নেয়া হয়েছে।
অতীব দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়ঃ বিশ্ব মুসলিম জাতির নেতা যেসব আলেম, আজকাল খাস খাস কিছু দেওবন্দী ওলামা ব্যতীত বাকী অধিকাংশই ১৫ই শা'বানে শবেবরাত উপলক্ষে যেসব বিদ্'আত ও শরী‘অত বিরোধী কার্যকলাপের আয়োজন জামে মসজিদে করে থাকে তা খুবই আপত্তিকর। যদি কেউ কখনো মসজিদের ইমাম মুয়াযযিনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে থাকে, তাহলে তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।
এছাড়াও শহর ও গ্রাম অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ জামে মসজিদে ইমাম সাহেব ১৩ ও ১৪ তারিখ থেকে মুসল্লিদের বলে দেয় যে, আপনারা আগামী কাল না পরশু শবে-বরাতের উপলক্ষে এলাকা হতে চাঁদা, চাল ডাল ইত্যাদি উঠাবেন। রাতে শিরনী পাকানো হবে। এতে মুসল্লিরা আনন্দচিত্তে ও ইবাদত মনে করে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে চাঁদা, চাল-ডাল ও নারিকেল ইত্যাদি উঠায় এবং রাতভর এগুলো পাকায় এবং শেষ রাতে মুসল্লিদের মাঝে তা বণ্টন করে থাকেন।
আর ইমাম সাহেব এই শিরনীর আয়োজন করতে পেরেছেন বলে সকলের জন্যে দু'আ করেন এবং খাস করে যারা টাকা-পয়সা, চাল-ডাল, নারিকেল ইত্যাদি দিয়েছেন, যারা এগুলোর জন্য কষ্ট পরিশ্রম করেছেন, তাদের জন্যে বেশী বেশী করে দু'আ করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে এটা আরো জোরদারভাবে করা যায়।
হে আল্লাহ! আলেমদের শুভবুদ্ধি দান করুন এবং বিদ্‘আত্ শরী অতে বিরোধী কার্যকলাপ হতে রেহাই দান করুন। দেশ ও জাতীর ঈমান হেফাজত করুন।
শবে বরাতের নামাযের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে শেষ কথা
শবে বরাতের নামাযের নিয়ম ও দোয়া সহ এ রাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলোচনা করেছি। এই আর্টিকেলে শবে বরাত সম্পর্কে আপনাদের সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শবে বরাত মহিমান্বিত ও বরকতময় একটি রজনী। এ রাতে অসংখ্য বান্দা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও কল্যাণ লাভ করেন। তাই এ রাত যথাযথভাবে কাটানো উচিত।
মনে রাখতে হবে ফরজ, নফলের চেয়ে বেশি উত্তম। শবে বরাতের নামায যেহেতু নফল সেহেতু নফল পড়তে পড়তে ফরজ পড়া ভুলে গেলে বা ঘুমের কারণে পড়তে না পারলে কিন্তু সবই শেষ। অর্থাৎ নফল নামায পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন আর এই দিকে ফজরের নামায পড়তে পারলেন না, সাবধান এ যেন না হয়। ভাল হয় শবে বরাতের নফল শেষ করে বেতের নামায পড়ে এর পর ফজর পড়া। যাই করেন নামায পড়েন আর ঘুমান সমস্যা নেই, ঠিক সময় মত উঠে ফজর নামায যেন পড়তে পারেন সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url