অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা


অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেণ্টাল ডিজঅর্ডার অর্থাৎ মানসিক বিকাশঘটিত সমস্যা। এটার অপর নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার। এক্ষেত্রে নার্ভ বা নার্ভাস সিস্টেম অর্থাৎ স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতা থাকে।
অটিজমের-প্রাথমিক-লক্ষণ-ও-চিকিৎসা
সাধারণত দেড় থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যেই শিশুর এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশু স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা, সামাজিক আচরণ, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। অটিজমের কারণে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার উপর দক্ষতাও কম থাকে।

পেইজ সূচিপত্রঃ অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা

অটিজম কি

অটিজম শিশুর মানসিক সমস্যাকে বোঝানো হয়। অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার একটি বিস্তৃত রূপ বা অটিজ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত। এখানে স্নায়ু শব্দটি স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সাথে স্নায়ুর সম্পর্ক বোঝায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, একটি শিশু মাতৃগর্ভ থেকে যেসব সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম।
মূলত অটিজমে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তি মাতৃগর্ভ থেকে মস্তিষ্কের বিকাশগত অসম্পূর্ণতাজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যার ফলে তাকে দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ ও আচার-আচরণ, গ্রহণমূলক ও প্রকাশমূলক ভাষা ব্যবহার, সংজ্ঞাপন ও সামাজিকতার ক্ষেত্রে নানা মাত্রার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, যা জীবনব্যাপী চলতে থাকে।

বিকাশজনিত শব্দটির মাধ্যমে শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়েছে। প্রাক শৈশবকাল থেকে এই সমস্যাটি শুরু হয়, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সাধারণত শিশুর জন্মের দেড় বছর থেকে তিন বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং আচরণের ভিন্নতাই এই সমস্যাটির প্রধান বিষয়।

এ ছাড়াও অটিজম রয়েছে এমন শিশুর শারীরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক শিক্ষণ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি সংক্রান্ত সমস্যাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটা মনে রাখা জরুরি যে, সব অটিস্টিক শিশুই এক রকম নয়। অটিজমের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সব অটিস্টিক শিশুর মধ্যে কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়। আবার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। অটিজম স্পেকট্রামে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অটিজম লক্ষ্য করা যায়।

অটিজম স্পেকট্রামকে একটি রংধনুর সাথে তুলনা করা যায়। রংধনুতে যেমন অনেক রং থাকে, অটিজম স্পেকট্রামের তেমনি বিভিন্ন ধরনের অটিজম থাকে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো অ্যাসর্পাজার্স সিনড্রোম। অটিজম শিশুর সামাজিক ও বাচনিক বিকাশের এক রকম প্রতিবন্ধকতা। অটিজম মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক সমস্যা বা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে।

মস্তিষ্কের অসমবিকাশ ও বিকাশগত প্রতিবন্ধকতাই অটিজম। আত্মসংবৃতি অর্থাৎ নিজের মধ্যে মগ্ন থাকা। সাধারণত কোনো কিছু শুনে শেখার চেয়ে দেখে শেখার প্রবণতা বেশি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার সাংকেতিক নম্বর হলো ৮৪.০।

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণগুলো একদম শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। মা-বাবা একটু সতর্ক হলে তা সহজেই ধরতে পারেন। স্বাভাবিক একটি শিশু এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, ১৬ মাস বয়স থেকে একটি শব্দ বলতে পারে এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে এসব আচরণ দেখা যায় না। তার সমবয়সী শিশুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না।
অটিজমে আক্রান্ত শিশু সবাভাবিক শিশুদের তুলনায় মানসিক বিকাশে পিছিয়ে থাকে এবং তার আচার-আচরণে নানা রকম অসংগতি দেখা যায়। সাধারণত তিন বছর বয়সের আগে এই রোগের উৎপত্তি ঘটে। মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলেশিশুদের মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার হার চার গুণ বেশি। অটিজমে আক্রান্ত শিশু সবার সঙ্গে মেলামেশার ভাষা খুঁজে পায় না, সামাজিক আচরণগুলো রপ্ত করতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, শিশুটির ব্যবহারের ধরন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে যায় এবং একই আচরণ বারবার করতে থাকে।

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণঃ

১। ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল না বলা, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা না করা।
২। ১৬ মাসের মধ্যে কোন একটি শব্দ বলতে না পারা।
৩। ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারা।
৪। ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাওয়া।
৫। বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করতে না পারা।

অটিজমের সাধারণ লক্ষণসমূহঃ

১। শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা
২। একবছর বয়সের মধ্যে দা…দ, বা…বা, বু…বু উচ্চারণ করতে না পারা।
৩। দুই বছর বয়সের মধ্যে অর্থপূর্ণ দুটি শব্দ দিয়ে কথা বলতে না পারা।
৪। শিশু যদি চোখে চোখ না রাখে।
৫। নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়া।
৬। অন্যের সাথে মিশতে সমস্যা হয় এবং আদর নিতে বা দিতে সমস্যা হয়।
৭। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে উঠা।
৮। পছন্দের বা আনন্দের বস্তু/ বিষয় সে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করতে না পারা।
৯। অন্যের বলা কথা বার বার বলা।
১০। বার বার একই আচরণ করা।
১১। শব্দ, আলো, স্পর্শ ইত্যাদি বিষয়ে কম বা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো।
১২। একটি নিজস্ব রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করা, আশেপাশের কোন পরিবর্তন সহ্য করতে না পারা।
১৩। নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা।
১৪। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পারা।

রেড ফ্ল্যাগ, অটিজমের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণঃ

১। স্বাভাবিক আচরণ করতে না পারা।
২। চোখে চোখ রেখে না তাকানো।
৩। আনন্দের বিষয়ে আনন্দ না পাওয়া।
৪। পছন্দের বিষয় কারো সাথে ভাগ করে না দেওয়া।
৫। নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়া।
৬। পরিবেশ অনুযায়ী মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন না করা।
৭। একই কাজ বারবার করা (হাত নাড়ানো, তালি দেয়া)।

অটিজমের সাথে অন্যান্য যেসব সমস্যা থাকতে পারেঃ

১। খিঁচুনি (মৃগী)
২। অতিচঞ্চলতা (হাইপার এক্টিভিটি)।
৩। স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন।
৪। হাতের কাজ করতে জটিলতা।
৫। হজমের সমস্যা।
৬। দাঁতের সমস্যা।

অটিজম কেন হয় অটিজমের কারণ

অটিজম কেন হয় অটিজমের কারণ এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, কিছু জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণে অটিজম দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল বা কিছু মৃগী রোগের ওষুধ সেবন করলে, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত স্থূলতা, ডায়বেটিস রোগে বা রুবেলায় আক্রান্ত হলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ৪ গুণ বেশি।

বেশি বয়সে সন্তান নিলে শিশুর অটিজমের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। শহুরে, শিক্ষিত, ধনী পরিবারে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এখন পর্যন্ত তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে কারণ অনুসন্ধানের কাজটিও বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন কারণে যে অটিজম হয়ে থাকে এ বিষয়ে বর্তমানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পর্যায়ে অটিজমের যে জটিল লক্ষণ দেখা যায় তা থেকে বলা যায়,

একাধিক কারণে অটিজম হতে পারে। জন্ম পূর্ব ও জন্মকালীন ও জন্ম-পরবর্তী যে কোনো সময়ে জেনেটিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের প্রভাবে অটিজম হতে পারে। কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমরে কিছু লক্ষণ থাকলেই তার অটিজম আছে এমন সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া যাবে না। কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই বলতে পারবেন শিশুটির অটিজম আছে কিনা। শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী কিংবা অটিজমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকই অটিজম নির্ণয় করতে পারবেন।

অটিজমের প্রকারভেদ

প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অটিজম কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত, বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরণের অটিজম সম্পর্কে কথা বলেছিলেন, যেমন অটিস্টিক ডিজঅর্ডার, এস্পারগার্স সিন্ড্রোম, ব্যাপ্তিশিীল বিকাশজনিত ব্যাধি অন্যথায় নির্দিষ্ট করা হয়নি (পিডিডি-এনওএস)। তবে এখন তাদের সবাইকে বলা হয় “অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার।” আসুন জেনে নেই সে সম্পর্কে-

অটিস্টিক ডিজঅর্ডারঃ কখনও কখনও এটি ক্লাসিক অটিজম নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণগুলি তীব্র ভাবে প্রকাশ পায়। এতে ভাষার বিলম্ব, সামাজিক ও যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা এবং অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায়। এছাড়াও শেখার অনাগ্রহ এবং কম বুদ্ধির হতে পারে।

এস্পারগার্স সিন্ড্রোমঃ লক্ষণ গুলি ক্লাসিক অটিজমের চেয়ে হালকা। এতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এদের কোনও ভাষা সমস্যা বা বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা নাও থাকতে পারে। তবে ভাষা বিকাশের কিছু ক্ষেত্র প্রভাবিত হতে পারে। মানুষের মানসিক অবস্থা বা মেজাজ বুঝতে সমস্যা হতে পারে। তবে কিছু শিশুদের ক্ষেত্রে এমন দক্ষতা রয়েছে যেখানে যুক্তি, স্মৃতি এবং সৃজনশীলতার প্রয়োজন যেমন গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং সংগীত।

ব্যাপ্তিশিীল বিকাশজনিত ব্যাধি, পিডিডি-এনওএসঃ এটি "এটিপিকাল অটিজম" নামেও পরিচিত। এই ক্ষেত্রে লক্ষণ বা উপসর্গগুলি এস্পারগার্স সিন্ড্রোম এর চেয়ে মারাত্মক, তবে অটিস্টিক ডিসঅর্ডার এর তুলনায় তীব্র নয়। অর্থাৎ এই শ্রেণীর ব্যক্তিরা অটিস্টিক ডিসঅর্ডার বা এস্পারগার্স সিন্ড্রোমের কিছু মানদণ্ড পূরণ করে, কিন্তু সবগুলিই নয়। তবে সামাজিক এবং যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে।

অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি

অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি খুবই নিবিড় ও বিশদভাবে হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের বাচ্চাদের জন্য এখন বাংলাদেশেই বিশেষায়িত কয়েকটি স্কুল আছে, যেখানে তাদের জন্য বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এটা নির্ভর করবে তার অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর পরামর্শের ওপর। তিনি বাচ্চার সক্ষমতা বুঝে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন কোন স্কুল তার জন্য ভালো হবে। 

অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বাংলাদেশে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে উঠেছে, এগুলো হলো প্রয়াস, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, সোয়াক, অটিস্টিক চিলড্রেন, ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। এ ছাড়া কিছু স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যারা অটিজম শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে কর্মরত রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা পেলে এসব প্রতিষ্ঠান আরও বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়।

অটিস্টিক শিশুদের জন্য শিক্ষাদান কার্যক্রম খুবই নিবিড় ও বিশদভাবে হওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীদের প্রয়োজন আছে এবং শিক্ষার্থীর আচরণ, বিকাশ, সামাজিক ও একাডেমিক প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে সপ্তাহে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য কত সময় ব্যয় করতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়। কেবলমাত্র একটি পদ্ধতিতে অটিস্টিক শিশুর শিক্ষাদান সম্ভব নয়। একসঙ্গে বা ক্রমান্বয়ে একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়।

প্রয়োগিত আচরণ বিশ্লেষণ নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে অনেকগুলো শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। অটিস্টিক শিশুদের সফলতার জন্য তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। সে জন্য ছোট ছোট সাফল্যও উল্লেখ করতে হবে এবং অটিজমের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর গুণাবলী জানা থাকলে উপযুক্ত পরিকল্পনা করতে সহায়ক হবে। অটিস্টিক শিশুদের সহপাঠীদের সহযোগী বন্ধু হিসেবে সর্বদা ভাবতে হবে।

সহপাঠীদের মধ্যে বন্ধুত্বের ধারণা এবং লক্ষ্য অর্জনে একতাবদ্ধ তার পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে অটিস্টিক শিশুরা যথাযথ সম্মান, সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। অটিজম সংক্রান্ত শিক্ষা বা সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ কোনো নিদিষ্ট শিক্ষার্থীর ওপর ভিত্তি করে হবে না, তা হতে হবে সার্বিকভাবে।

অটিজমের ঝুঁকির কারণসমূহ

অটিজমের ঝুকির বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কিছু পরিচিত জেনেটিক ডিসঅর্ডার অটিজমের জন্য বাড়তি ঝুঁকির সাথে যুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে ফ্র্যাগাইল এক্স সিনড্রোম (যা বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা সৃষ্টি করে) এবং টিউবারাস স্কেলেরোসিস (যা মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে সৌম্য টিউমার বৃদ্ধির কারণ হয়ে থাকে) - যার প্রত্যেকটির মধ্যে পরিবর্তন ঘটে একটি একক, কিন্তু ভিন্ন, জিন।
  • ছেলে শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
  • কিছু কিছু রোগের জন্য অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের লক্ষণ স্বাভাবিক ঝুঁকির চেয়ে বেশি থাকে। এইসব রোগের মধ্যে রয়েছে ফ্রাজাইল এক্স সিনড্রোম, টিউবারাস স্ক্লেরোসিস, টুরেট সিনড্রোম, রিট সিনড্রোম, সেরিব্রাল ডাইজেজনেসিস এবং মৃগী।
  • বেশি বয়সে গর্ভধারণ।
  • এক বছরের কম ব্যবধানে সন্তান ধারন।
  • গর্ভকালীন বা প্রসবকালীন ওষুধ ব্যবহারে অসতর্ক থাকলে।
  • গর্ভাবস্থায় রক্তপাত।
  • মাতৃগর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
  • গর্ভধারণের ২৬ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • বেশী বয়ষ্ক বাবা-মা এবং অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে একটি সংযোগ থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন তবে গবেষকরা এটা নিয়ে এখন গবেষণা করছেন।

অটিজমের ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

অটিজমের যেহেতু কোনো নিরাময় নেই, তাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে।

  • বেশি বয়সে সন্তান না নেওয়া।
  • সন্তান নেওয়ার আগে মাকে এমএমআর (MMR) ভ্যাক্সিন দিতে হবে।
  • গর্ভাবস্থায় ভালোমানের ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ও নিয়মিত শরীরচর্চা করা।
  • গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ না খাওয়া।
  • গর্ভাবস্তায়,গর্ভের পূর্বে এবং পরবর্তিতে ফলিক এসিড এর পর্যাপ্ততা।
  • কেমিক্যাল, কীটনাশকযুক্ত খাবার না খাওয়া।
  • পরিবেশ দূষণ থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
  • গর্ভাবস্থায় নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা।
  • নিয়মিত চেক-আপ করুন, সুষম খাবার খান এবং ব্যায়াম করুন।
  • ধূমপান, মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে সন্তান নেওয়ার আগে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে।
  • শিশুর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে সচেতন হওয়া। শিশুকে সময় দেওয়া, খেলা করা, নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এতে শিশুর বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়।

অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতি

অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। তবে অটিজমের দ্রুত চিকিৎসা, যথোপযোগী স্কুল শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং সঠিক স্বাস্থ্যসেবা একটি শিশুর অটিজমের সমস্যাগুলো অনেক হ্রাসকরে, শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা ও নতুন দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সেটা হতে পারে প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ কৌশল, ভাষা এবং যোগাযোগ, এবিএ ভিত্তিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও অন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক নির্ভর প্রশিক্ষণ কৌশল।

অনেক ক্ষেত্রে অটিস্টিক বাচ্চাদের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়, যদি তা দ্রুত নির্ণয় করা যায়। এই চিকিৎসা হচ্ছে একটি সম্বন্নিত চিকিৎসা যা পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্টের সহযোগিতায় প্রতিটি অটিস্টিক বাচ্চার জন্য আলাদা আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়।

অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন অতি চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, মনোযোগের সমস্যা, ঘন ঘন মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি থাকে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় সাইকিয়াট্রিস্ট ওষুধের ব্যবহার করে থাকেন। অটিস্টিক শিশুদের কোনো ‘মিরাকল চিকিৎসা’ নেই। পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, সমাজ, শিক্ষক-শিক্ষিকা, চিকিৎসকসহ সকলের সাহায্য সহযোগিতায় একটি অটিস্টিক শিশুর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় ও অর্থবহুল।

অটিজম সম্পর্কে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর


অটিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য কোনটি?

এ সমস্যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনে বাধা, আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানে সমস্যা এবং একই ধরনের আচরণের পুনরাবৃত্তি করা। অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের ভাষা শিখতে সমস্যা হয়, শব্দ বা স্পর্শের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা বা সংবেদনহীনতা থাকতে পারে, পাশাপাশি কখনো কখনো আচরণের সমস্যা দেখা দেয়।

অটিজম কখন প্রকাশ পায়?

সাধারণত শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের পর্যায়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৮ মাস থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই) অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়। অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মায়ের কারণে কি অটিজম হয়?

মায়ের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ASD-এর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ । এপিডেমিওলজিকাল গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে হরমোনের অস্বাভাবিকতা সন্তানদের মধ্যে অটিজমের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ এবং যৌন হরমোনগুলি অটিজমের কারণের অংশ হতে পারে।

মৃগী রোগ কি অটিজমের লক্ষণ?

সাধারণ জনগণের তুলনায় অটিস্টিক ব্যক্তিদের মধ্যে মৃগীরোগ বেশি দেখা যায় যাদের লক্ষণগুলি কিশোর বয়সে বিকাশের সম্ভাবনা বেশি। পরিবারের কারোর এই ব্যাধি থাকলে মৃগীরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেসব পরিবারে মৃগী রোগ আছে তাদের মধ্যেও অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মৃগীরোগ এবং অটিজম প্রায়ই একসাথে ঘটে।

অটিজম প্রতিরোধের উপায়?

প্রতিরোধ। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার প্রতিরোধ করার কোন উপায় নেই , তবে চিকিত্সার বিকল্প রয়েছে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং হস্তক্ষেপ সবচেয়ে সহায়ক এবং আচরণ, দক্ষতা এবং ভাষার বিকাশকে উন্নত করতে পারে। যাইহোক, হস্তক্ষেপ যে কোন বয়সে সহায়ক।

অটিস্টিক শিশুদের প্রতি পিতা-মাতার ভূমিকা

অটিস্টিক শিশুদের প্রতি পিতা-মাতাদের অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে। তাদের প্রতি সুন্দর সহজ, সরল ব্যবহার করতে হবে। কোনো কারণে অটিস্টিক শিশুরা কান্নাকাটি চেঁচামেচি করলে সাথে সাথে তাদের চাহিদা পূরণ করতে হবে। তাদের প্রতি সর্বদা হাসি, খুশি এবং চলাফেরা খেলাধুলার যেন বিঘ্ন না ঘটে তা সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

এদের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে সেই প্রতিভা খুঁজে বের করে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। এ জন্য বাবা, মা, অভিভাবককে অধিক যত্নশীল হতে হবে। স্কুলের শিক্ষকগণকেও একই পদ্ধতি অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে হবে। হেলেন কেলার শিক্ষকের আদর যত্নে এবং প্রশিক্ষণে ভালো হয়ে বিশ্বকে জয় করেছিলেন। তার মতো এরাও দেশের নাগরিক।

তারাও বিশ্বকে জয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। পারবে দেশ এবং সমাজ গঠন করতে এবং দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে। তাই, অটিস্টিক শিশুকে অবহেলা না করে তাদেরকে সেবাযত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে সক্ষম ও কর্মক্ষম করে তোলা সমাজের প্রতিটি মানুষের উচিত।

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে শেষকথা

সাধারণত সারা জীবন ধরে অটিজমের লক্ষণগুলো একজনের মধ্যে থাকতে পারে। তবে যথাযথ সাহায্য, নির্দেশনা ও উপযুক্ত শিক্ষা পেলে সময়ের সঙ্গে কিছু কিছু লক্ষণের উন্নতি হয়। যাদের মাঝে অল্প মাত্রার সমস্যা থাকে তাদের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় এবং তারা মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মাঝারি ও বেশি সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা ঠিকমতো কথা বলতে পারে না এবং নিজের যত্নও নিতে পারে না।

তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এবং নিবিড় প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা পেলে অটিস্টিক শিশুরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে পারে। অটিস্টিক শিশুদের কোনো বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা বা ক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায়। এর সংখ্যা খুবই কম তবুও এ ধরনের বিশেষ দক্ষতা তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং তাদেরকে করে তোলে অসাধারণ। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, প্রতিটি অটিস্টিক শিশুর মধ্যে এ ধরনের বিশেষ প্রতিভা থাকবে।

তবে এ বিষয়ে সচেতন থাকলে তাদের সুপ্ত প্রতিভা খুঁজে বের করা সহজ হবে, শিশুটি সমাজে সমাদৃত হবে এবং তার অন্যান্য দিকের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে। অটিস্টিক শিশুরা যে বিষয়টির ওপর বেশি মনোযোগ দেয় সেদিকেই তাদের প্রতিভা বিকাশিত হতে পারে। আশা করছি অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক তথ্য ও ধারনা পেয়েছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url