হাইপোথার্মিয়া কি-হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার জেনে নিন
হাইপোথার্মিয়া কি-হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে আর্টিকেলটি
মনযোগ সহকারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। আমাদের দেহের আদর্শ তাপমাত্রা ৩৭
ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় দেহ একদম সুস্থ। তাপমাত্রা এর চেয়ে কিছু কম-বেশি
হলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারে দেহ।
কিন্তু পার্থক্যটা কয়েক ডিগ্রি হলে দেহের ভেতরে শুরু হয় গোলমাল। কারণ তাপমাত্রা
প্রাণিদেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর কমা-বাড়ার কারণে দেহের স্বাভাবিক
কর্মকাণ্ড ব্যহত হলে, দেহ নিজেই নানাভাবে চেষ্টা করে তাপমাত্রাকে সহনীয় মাত্রায়
রাখার জন্য। অতি ঠান্ডার কারণে যে ধরনের শারীরিক জটিলতা হয়, তার নাম
হাইপোথার্মিয়া।
পেইজ সূচিপত্রঃ হাইপোথার্মিয়া কি-হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার
হাইপোথার্মিয়া কি
হাইপোথার্মিয়া কি, হাইপোথার্মিয়া সাধারণত নিম্ন শরীরের তাপমাত্রা হিসাবে
পরিচিত। হাইপোথার্মিয়া (Hypothermia) হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে দেহের
তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়, সাধারণত ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৫ ডিগ্রি
ফারেনহাইট) এর নিচে। এটি সাধারণত ঘটে যখন শরীর ঠান্ডা আবহাওয়া বা ঠান্ডা পানির
সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে এবং শরীর পর্যাপ্ত তাপ উৎপন্ন করতে পারে না।
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৮.৬ ফারেনহাইট)।
তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গেলে শ্বাসযন্ত্র, হৃৎপিণ্ড ও অন্যান্য
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যদি হাইপোথারমিয়া চিকিত্সা না
করা হলে, এটি শ্বাসযন্ত্র এবং হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ হবে এবং এটি মৃত্যু
পর্যন্ত হতে পারে। তাই হাইপোথার্মিয়ার জটিলতা এড়াতে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে অবস্থা মারাত্মক হতে
পারে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। তবে দেহের তাপমাত্রা আরও কমলে
কাঁপুনি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যেতে
পারেন। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে দেহ নিজেকে উষ্ণ করে তোলার
ক্ষমতা হারায়। এ অবস্থায় অনেকেই মৃত্যু বরণ করেন।
হাইপোথার্মিয়ার ঠিক উল্টো হাইপারথার্মিয়া। আমাদের দেহে আছে স্বয়ংক্রিয় তাপ
নিষ্কাশন পদ্ধতি। দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে সাধারণত ঘাম হয়। ঘামের
মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ বেরিয়ে যায়। ঘাম হিসেবে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল
বাষ্পীভূত হয়ে কিছুটা তাপ কমিয়ে দেয় শরীরের।তবে শরীর কোনো কারণে অতিরিক্ত তাপ বের
করে দিতে না পারলে অভ্যন্তরীন তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
এ সময় মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব হতে পারে। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেতে পারে শরীরে পানি
শূন্যতা তৈরি হওয়ায়। হতে পারে মাথাব্যথা। একই কারণে এ সময় শরীরের রক্তনালী
প্রসারিত হয়। ত্বকের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় উষ্ণ রক্ত। রক্তের ঘনত্ব এ সময়
উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। ফলে হ্রাস পায় রক্তচাপ। এ জন্য মাথা ঘোরা বেড়ে
যাওয়াসহ অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
দেহের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে দেহকোষ বিকৃত হওয়া শুরু করে।
কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। এমনকি কোষ মারাও যেতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা
না করলে হতে পারে হাইপারথার্মিয়া। এতে অঙ্গ-বিকল হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ সময় হিট
স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। তো বুঝতেই পারছেন, অতিরিক্ত ঠান্ডা বা
অতিরিক্ত গরম দুটোই আমাদের জন্য প্রাণঘাতী।
হাইপোথার্মিয়াতে শরীর কিভাবে তাপ হারায়
হাইপোথার্মিয়া হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় এবং তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। হাইপোথার্মিয়ায়, যখন শরীরের মূল তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যায়, তখন শরীর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ হারায়। শরীর সাধারণত চারটি প্রধান উপায়ে তাপ হারায়, যা হাইপোথার্মিয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এগুলো হলঃ
১. বিকিরণ (Radiation) শরীর তার আশেপাশে তাপ বিকিরণ করে। যখন আশেপাশের
পরিবেশ শরীরের চেয়ে ঠান্ডা হয়, তখন ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে শীতল পরিবেশে তাপ হারিয়ে
যায়। শরীর থেকে তাপ সরাসরি বায়ুমণ্ডলে বিকিরণের মাধ্যমে হারিয়ে যায়। শরীরের
ত্বক বিশেষত মাথা এবং হাত থেকে সবচেয়ে বেশি তাপ বিকিরণ হয়, বিশেষ করে যদি শীতল
পরিবেশে থাকেন এবং তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি হয়।
- শীতকালে গরম পোশাক ছাড়া বাইরে থাকলে শরীর থেকে প্রচুর তাপ বিকিরিত হয়।
- মাথা শরীরের তাপমাত্রার বড় অংশ ধরে রাখে। তাই এটি উন্মুক্ত থাকলে বিকিরণের মাধ্যমে তাপ দ্রুত হারায়।
২. পরিবহণ (Convection) ঠান্ডা পৃষ্ঠ বা বস্তুর সাথে সরাসরি
যোগাযোগের মাধ্যমে তাপের ক্ষতি ঘটে। যদি কোনও ব্যক্তি ঠান্ডা পৃষ্ঠের সাথে
সরাসরি যোগাযোগ করে, তবে শরীর থেকে এই বস্তুগুলিতে তাপ স্থানান্তরিত হয়।
শরীরের চারপাশে বায়ু বা পানি প্রবাহের মাধ্যমে তাপ হারায়। ঠান্ডা বাতাস
শরীরের তাপ শোষণ করে এবং গরম বায়ু বা পানি দূরে সরে গেলে শরীর ঠান্ডা হয়ে
যায়। উদাহরণস্বরূপ, ঠান্ডা বাতাসে বা পানিতে থাকার সময় এই প্রক্রিয়া
ত্বরান্বিত হয়।
উদাহরণঃ
- ঠান্ডা বাতাসে ভেজা কাপড় পরিধান করা।
- নদী বা সাগরে পড়ে গেলে তাপ দ্রুত হারায়।
৩. পরিবাহিতা (Conduction) শরীরের চারপাশে বায়ু বা তরল স্রোত,
বিশেষ করে ঠান্ডা বাতাস বা জল, ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে তাপ দূর করতে পারে। শরীর ভেজা
হলে এই প্রভাবটি বৃদ্ধি পায়। ঠান্ডা পৃষ্ঠ বা বস্তু স্পর্শ করার মাধ্যমে শরীর
তাপ হারায়। উদাহরণস্বরূপ, ঠান্ডা মাটিতে বসা বা ঠান্ডা ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে
এলে শরীর থেকে তাপ দ্রুত হারিয়ে যায়।
উদাহরণঃ
- ঠান্ডা মাটিতে বসে থাকা।
- ভেজা কাপড় পরে শীতল বস্তুর ওপর বসা বা শোয়া।
৪. বাষ্পীভবন (Evaporation) কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, যেমন ঘাম
বা শ্বাস-প্রশ্বাস, বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর তাপ হারায়। জামাকাপড় ভিজে গেলে
বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে শরীর আর্দ্রতা বাষ্পীভবনের মাধ্যমে তাপ হারাতে পারে।
যখন ঘাম বাষ্পীভূত হয়, এটি শরীর থেকে তাপ শোষণ করে। ঠান্ডা পরিবেশে ভেজা পোশাক
পরলে এই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়।
- ভারী পরিশ্রম বা দৌড়ানোর পর ঘাম শরীর থেকে তাপ শোষণ করে ঠান্ডা অনুভূতি সৃষ্টি করে।
- শীতল পরিবেশে ভেজা পোশাক দ্রুত তাপ হ্রাস ঘটায়।
হাইপোথার্মিয়ার প্রকারভেদ
হাইপোথার্মিয়ার প্রকারভেদ শারিরীক অবস্থার উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়।
হাইপোথার্মিয়া হলো শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যাওয়া, যা
জীবন-হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত ঠান্ডা পরিবেশে বেশি ঘটে।
হাইপোথার্মিয়া সাধারণত তিনটি প্রকারে ভাগ করা যায়, তাপমাত্রার স্তরের ওপর
ভিত্তি করে। এখানে হাইপোথার্মিয়ার বিভিন্ন প্রকার বা শ্রেণীবিভাগ রয়েছে
চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুনঃ কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
১. প্রাথমিক হাইপোথার্মিয়াঃ প্রাথমিক হাইপোথার্মিয়া হলো এমন
একটি অবস্থা যেখানে শরীরের তাপমাত্রা শীতল পরিবেশে থাকার কারণে স্বাভাবিকের
নিচে নেমে যায়। এটি শরীরের বাইরের পরিবেশজনিত তাপ হ্রাসের ফলে ঘটে এবং এতে
কোনো অন্তর্নিহিত শারীরবৃত্তীয় সমস্যা জড়িত থাকে না।
প্রাথমিক হাইপোথার্মিয়ার কারণ
- শীতল আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময় থাকা।
- বরফের মধ্যে পড়ে যাওয়া বা ঠান্ডা পানিতে ডুবে যাওয়া।
- ভেজা কাপড় পরে শীতল পরিবেশে থাকা।
- গরম পোশাকের অভাব।
- বায়ু প্রবাহিত বা বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়ায় শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
২. সেকেন্ডারি হাইপোথার্মিয়াঃ সেকেন্ডারি হাইপোথার্মিয়া হলো
এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরের তাপমাত্রা মূলত শরীরের ভেতরের কোনো
শারীরবৃত্তীয় বা রোগগত সমস্যার কারণে বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। এটি সাধারণত
শরীরের তাপ উৎপাদন বা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে ঘটে।
সেকেন্ডারি হাইপোথার্মিয়ার কারণসমূহ
মেটাবলিক বা এন্ডোক্রাইন কারণ
- হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব)।
- অ্যাড্রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি।
- ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস।
- মস্তিষ্কের আঘাত বা স্ট্রোক।
- মস্তিষ্কে সংক্রমণ (এনসেফালাইটিস)।
- মেরুদণ্ডের আঘাত।
- সেপসিস (গুরুতর সংক্রমণ)।
- রক্তপাত বা শক।
- মাল্টি-অর্গান ফেলিউর।
ঔষধ বা মাদকদ্রব্য
- সেডেটিভ ওষুধের অতিরিক্ত সেবন।
- অ্যালকোহল বা নেশাজাতীয় পদার্থ।
৩. তীব্র হাইপোথার্মিয়াঃ তীব্র হাইপোথার্মিয়া (Severe
Hypothermia) হলো একটি মারাত্মক শারীরবৃত্তীয় অবস্থা যেখানে শরীরের
তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে যায়, সাধারণত ৩০° সেলসিয়াস (৮৬°
ফারেনহাইট) বা তার কম। এটি চিকিৎসার অভাবে প্রাণঘাতী হতে পারে।
কারণসমূহঃ
- শীতল পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকা।
- ঠান্ডা পানিতে ডুবে যাওয়া।
- ভেজা জামাকাপড় পরে ঠান্ডায় থাকা।
- শরীরের তাপ উৎপাদন কমে যাওয়া (যেমন: খিদে, অবসাদ)।
অবস্থার তীব্রতা এবং অন্তর্নিহিত কারণগুলির উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত চিকিত্সা
এবং ব্যবস্থাপনা নির্ধারণের জন্য এই ধরনের হাইপোথার্মিয়ার মধ্যে পার্থক্য
করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুতর হাইপোথার্মিয়ার জন্য অবিলম্বে চিকিত্সার
পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি জীবন-হুমকি হতে পারে।
হাইপোথার্মিয়ার কারণ
হাইপোথার্মিয়া একটি অবস্থা যেখানে শরীরের তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়,
সাধারণত ৩৫°C (৯৫°F) এর নিচে চলে গেলে। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের
ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ঘটে। এটি শরীরের তাপমাত্রা অত্যধিক কমে যাওয়ার একটি
বিপজ্জনক অবস্থা যা শারীরিক কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং শেষ পর্যন্ত জীবন
হানির কারণ হতে পারে। এর বিভিন্ন কারণ, উপসর্গ, প্রভাব এবং চিকিৎসা সম্পর্কেও
বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
তীব্র ঠান্ডা পরিবেশে অবস্থানঃ অত্যধিক ঠান্ডা পরিবেশে
বেশিক্ষণ অবস্থান করা, যেমন বরফ বা তুষারে বেশি সময় কাটানো, শরীরের
তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে দিতে পারে। শীতের সময়ে, বিশেষ করে বরফ এবং
তুষার-covered এলাকাতে অতিরিক্ত সময় কাটানো। ঠান্ডা বাতাস বা পানি শরীরের
তাপমাত্রা দ্রুত কমাতে সহায়ক। দীর্ঘ সময় ধরে ঠান্ডা অবস্থায় কাজ করা বা
বাইরে থাকা, যেমন স্কিইং, হাইকিং, বা শীতকালীন কর্মকাণ্ডের সময়।
ভিজে থাকাঃ শরীর ভিজে গেলে, বিশেষত ঠান্ডা পানিতে, শরীরের
তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে। ভিজে কাপড় পরিধান করলে তাপ হারানোর গতি বাড়ে,
কারণ পানি তাপ শোষণ করে এবং দ্রুত শরীরের তাপ কমিয়ে দেয়। বিশেষভাবে তুষার বা
বরফের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হলে ভিজে হওয়া বেশি বিপজ্জনক।
বিভিন্ন অসুস্থতা বা শারীরিক অবস্থাঃ অসুস্থতা, যেমন সেপসিস, কম
ঘুম, শক, অথবা থাইরয়েডের সমস্যা (হাইপোথাইরয়ডিজম), শরীরের তাপমাত্রা কমাতে
পারে। শারীরিক দুর্বলতা, সেপসিস (একটি গুরুতর সংক্রমণ), বা কিডনি
সমস্যা হাইপোথার্মিয়া সৃষ্টি করতে পারে। থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি থাকলে
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও রক্তে
হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকলে শরীরের তাপ পরিবহন ও উৎপাদন কমে যায়।
অ্যালকোহল বা মাদক সেবনঃ অ্যালকোহল শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়
এবং মাদক ব্যবহারও একই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। অ্যালকোহল শরীরের তাপমাত্রা
কমিয়ে দেয় কারণ এটি রক্তনালী প্রসারিত করে, যার ফলে তাপ দ্রুত হারানো শুরু
হয়। মাদক সেবন যেমন কোকেইন বা মেরিখুয়ানা ব্যবহারও হাইপোথার্মিয়া
সৃষ্টি করতে পারে।
কর্মক্ষমতা কম থাকা বা ক্লান্তিঃ অধিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। শরীরের শক্তির
অভাব, ক্ষুধা বা দীর্ঘ সময় ঘুমানোর অভাব শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন
ঘটায়। বিশেষ করে অসুস্থ বা দুর্বল মানুষের জন্য এটি অধিক বিপজ্জনক হতে
পারে। শিশু এবং বয়স্ক মানুষদের মধ্যে হাইপোথার্মিয়া ঘটার সম্ভাবনা
বেশি থাকে কারণ তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম হতে পারে।
হাইপোথার্মিয়ার প্রভাব
হাইপোথার্মিয়ার প্রভাবে শরীর অতিরিক্ত তাপ বের করে দিতে না পারলে অভ্যন্তরীন
তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এ সময় মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব ও প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেতে
পারে শরীরে পানি শূন্যতা তৈরি হওয়ায়। হতে পারে মাথাব্যথা। একই কারণে এ সময়
শরীরের রক্তনালী প্রসারিত হয়। ত্বকের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় উষ্ণ রক্ত। রক্তের
ঘনত্ব এ সময় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। ফলে হ্রাস পায়
রক্তচাপ।হাইপোথার্মিয়ার প্রভাবগুলো জেনে নিন।
শরীরের কার্যকলাপ ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করেঃ হাইপোথার্মিয়া
শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হয়। হাইপোথার্মিয়া
শরীরের মেটাবলিজম কমিয়ে দেয়, ফলে হৃদস্পন্দন ও শ্বাসের হার ধীর হয়ে যায়।
হাত-পায়ের আঙুল এবং কানসহ শরীরের প্রান্তিক অংশগুলো অসাড় হতে পারে।
অন্ত্র বা পাচনতন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারেঃ শরীরের
তাপমাত্রা কমে যাওয়ার প্রথম লক্ষণ হলো ঠান্ডা লাগা। অত্যধিক ঠান্ডায়
রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে পাচনতন্ত্রের কার্যকলাপ ব্যাহত হতে
পারে। রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ার কারণে চামড়া ফ্যাকাসে বা নীলচে হতে
পারে।যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে হৃদয়, ফুসফুস, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করতে পারে।
মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হতে পারেঃ হাইপোথার্মিয়া মানসিকভাবে
বিভ্রান্তি বা অসংলগ্নতার সৃষ্টি করতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলে
মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ফলে মানসিক বিভ্রান্তি দেখা
দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি খুবই ক্লান্ত এবং ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা দেখাতে
পারে। যাদের তাপমাত্রা খুব কম হয়, তারা বোকামি বা অস্বাভাবিক আচরণ করতে
পারে। মানসিক স্থিতিশীলতা কমে যাওয়ার কারণে ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত
নিতে পারে না। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সুরক্ষা বা উষ্ণতার জন্য
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে না। কখনও কখনও "প্যারাডক্সিক্যাল আন্ড্রেসিং"
(নিজের পোশাক খুলে ফেলা) দেখা যেতে পারে।
হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণ
হাইপোথার্মিয়া হলো এমন একটি বিপজ্জনক অবস্থা যেখানে শরীরের তাপমাত্রা
স্বাভাবিকের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এটি সাধারণত ঠান্ডা পরিবেশে
দীর্ঘ সময় থাকার কারণে ঘটে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হলে জীবন-হুমকিপূর্ণ
হতে পারে। যদি কারও হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসা
গ্রহণ করা জরুরি। উষ্ণ পরিবেশে নিয়ে গিয়ে গরম কাপড় বা কম্বল দিয়ে ঢেকে
রাখা এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রাথমিক লক্ষণ (Mild Hypothermia)
- কাঁপুনিঃ শরীর তাপ উৎপন্ন করার চেষ্টা করে।
- ঠান্ডা অনুভূতিঃ ব্যক্তি খুব বেশি ঠান্ডা অনুভব করে।
- ত্বক শীতল ও ফ্যাকাশেঃ রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ায় ত্বকের রং বদলাতে পারে।
- ক্লান্তি বা অলসতাঃ ব্যক্তি নিজেকে দুর্বল বোধ করতে পারে।
- বিচলিত বা মেজাজ খিটখিটে হওয়াঃ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ধীর হয়ে যাওয়ায় আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়।
মধ্যম পর্যায়ের লক্ষণ (Moderate Hypothermia)
- কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যাওয়াঃ শরীরের শক্তি এত কমে যায় যে কাঁপুনি থেমে যায় (যা বিপদজনক)।
- ধীর শ্বাসঃ শ্বাসের হার কমে যায়।
- হৃদস্পন্দনের হার কমে যাওয়াঃ রক্ত প্রবাহ ধীর হয়ে যায়।
- বিভ্রান্তি ও স্মৃতিভ্রংশঃ ব্যক্তি কথা বলতে বা চিন্তা করতে সমস্যা অনুভব করে।
- চলাফেরা বা সামঞ্জস্য হারানোঃ হাঁটতে বা দাঁড়াতে সমস্যায় পড়ে।
- চোখে ক্লান্তিঃ ব্যক্তি ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছা অনুভব করতে পারে।
গুরুতর পর্যায়ের লক্ষণ (Severe Hypothermia)
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়াঃ ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতে পারে।
- শ্বাস বন্ধ হওয়াঃ শরীরের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ হতে শুরু করে।
- হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়াঃ শরীর তাপমাত্রা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে এটি ঘটে।
- পারাডক্সিক্যাল আনড্রেসিংঃ ব্যক্তি অদ্ভুতভাবে কাপড় খুলতে শুরু করে। এটি মস্তিষ্কের বিভ্রান্তির কারণে ঘটে।
- মৃত্যুর সম্ভাবনাঃ চিকিৎসা না পেলে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
হাইপোথার্মিয়া প্রতিকারে বিস্তারিত পদক্ষেপ
হাইপোথার্মিয়া প্রতিকারে বিস্তারিত পদক্ষেপগুলো আর্টিকেলের এই অংশ থেকে
জেনে নিতে পারেন। হাইপোথার্মিয়া (Hypothermia) হলো শরীরের তাপমাত্রা
স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যাওয়ার একটি অবস্থা। এটি একটি গুরুতর
অবস্থা, যা তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে জীবননাশের কারণ হতে পারে।
হাইপোথার্মিয়া প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুনঃ অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা
১. স্থান ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা থেকে সরিয়ে উষ্ণ ও শুকনো স্থানে নিয়ে যান।
- বাতাস, ঠান্ডা মাটি বা পানি থেকে শরীর আলাদা করতে কম্বল বা শুকনো কাপড় ব্যবহার করুন।
২. পোশাক পরিবর্তন
- ভেজা বা ঠান্ডা পোশাক দ্রুত খুলে ফেলুন।
- শুকনো, উষ্ণ এবং ঢিলা পোশাক পরান।
- মাথা, ঘাড়, এবং পায়ের তলা ঢাকা রাখার জন্য অতিরিক্ত কাপড় ব্যবহার করুন।
৩. শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর উপায়
প্রাকৃতিক তাপঃ নিজের শরীরের তাপ ব্যবহার করতে পারেন।
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে রাখুন।
- উভয়ের মধ্যে কাপড় বা কম্বল রাখুন।
বাইরের উৎস থেকে তাপঃ হিটিং প্যাড, গরম বোতল, বা উষ্ণ কাপড় ব্যবহার
করুন।
- এগুলো ব্যবহার করলে বুক ও গলার কাছে রাখুন।
- হাত, পা বা শরীরের শেষ প্রান্তে সরাসরি তাপ প্রয়োগ করবেন না, কারণ এটি রক্তচলাচলের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
৪. পুষ্টি ও হাইড্রেশন
যদি আক্রান্ত ব্যক্তি জেগে থাকে এবং গিলতে সক্ষম হয়
- হালকা গরম পানীয় দিন (যেমন গরম পানি, সুপ)।
- উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত খাবার (যেমন চকোলেট, শুকনো ফল) খেতে দিন।
অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো শরীরের তাপমাত্রা আরও
কমিয়ে দিতে পারে।
৫. জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া (জরুরি ক্ষেত্রে)
যদি শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বা হৃদস্পন্দন না থাকে
- কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (CPR) শুরু করুন।
- যতক্ষণ না পেশাদার মেডিকেল সহায়তা আসে, CPR চালিয়ে যান।
হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধে করণীয়
হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধে করণীয় কি তা জানতে পারবেন এই অংশটি পড়ে।
হাইপোথার্মিয়া (Hypothermia) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরের
তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। এটি সাধারণত শীতল পরিবেশে দীর্ঘ সময়
অবস্থান করার ফলে ঘটে। হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ
করণীয় বিষয় নিচে উল্লেখ করা হলো যেগুলো জানা থাকলে আপনার উপকারে আসতে
পারে।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url