আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয়


আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয় এই প্রশ্নটি সম্পর্কে জানতে আপনারা অনেকেই গুগল ও ইউটিউবে সার্চ করে থাকেন। আয়োডিন হলো একটি মৌলিক পদার্থ যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। দেহে আয়োডিনের অভাব হলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হাইপোথাইরয়ডিজম
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যদি আয়োডিন উপাদানটি না থাকে তাহলে আমাদের দেহে আয়োডিনের ঘাটতি তৈরি হয়। আয়োডিনের ঘাটতি হলে আমাদের শরীরে গলগন্ড রোগ দেখা দেয়। আয়োডিনের এ ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার জন্য আমাদের অবশ্যই খাদ্যের সঙ্গে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয় তা নিচে আলোচনা করাহলো।

পেইজ সূচিপত্রঃ আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয়

আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয়

আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয় তা অনেকেই জানেন না। আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা আমাদের শরীরের থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে প্রয়োজন। আয়োডিনের অভাব হলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য খাদ্যতালিকায় আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত খাবার এবং আয়োডিনযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। নিচে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো।

গলগণ্ডঃ আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্রন্থি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা থুলে যায়, যাকে গলগণ্ড (Goiter) বলা হয়। এটি ঘাড়ে ফোলা আকারে দেখা যায়। থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি করতে না পারলে বড় হয়ে যায়। আয়োডিন শরীরের জন্য একটি অপরিহার্য খনিজ, যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থি কম সক্রিয় হলে এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেম থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করলে গলগণ্ড হতে পারে। কখনও কখনও থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার হলে গলগণ্ড হতে পারে।

হাইপোথাইরয়ডিজমঃ আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য অত্যাবশ্যক। খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতি হলে হাইপোথাইরয়ডিজম হতে পারে। হাইপোথাইরয়ডিজম হলো এক ধরণের থাইরয়েড সমস্যাজনিত রোগ, যেখানে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। থাইরয়েড হরমোন শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া, শক্তি উৎপাদন, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোনের অভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা ধীর হয়ে যায়। থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করতে পারে না, ফলে ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, এবং ত্বক শুষ্ক হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।

ক্রেটিনিজমঃ ক্রেটিনিজম (Cretinism) হলো এক ধরণের রোগ, যা শিশুদের মধ্যে থাইরয়েড হরমোনের দীর্ঘমেয়াদী ঘাটতির কারণে হয়ে থাকে। এটি জন্মগত বা শৈশবে বিকাশজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। থাইরয়েড হরমোন শরীরের বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি থাইরয়েড হরমোনের অভাব হয়, তাহলে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মায়ের খাদ্যে আয়োডিনের অভাব থাকলে গর্ভাবস্থায় শিশুর থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সমস্যা হয়।

প্রজনন সমস্যাঃ গর্ভকালীন থাইরয়েড হরমোন শতকরা ৫০ ভাগ বেশি উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোনের জন্য বেশি মাত্রার আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। গর্ভধারণের ১১ সপ্তাহ থেকে ভ্রূণের থাইরয়েডগ্রন্থি কাজ শুরু করে। ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ পূর্ণ হলে ভ্রূণ তার নিজস্ব থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন শুরু করে। সেই সময় থেকে শিশুর তিন বছর বয়স পর্যন্ত সঠিক মাত্রার আয়োডিন গ্রহণ মা ও শিশু উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় মস্তিষ্ক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

এই সময় আয়োডিনের অভাব হলে বা পর্যাপ্ত আয়োডিন না পেলে মস্তিষ্কেও স্থায়ী ক্ষতিসহ আয়োডিন ঘাটতিজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের খুব বেশি অভাব দেখা দিলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে। এই সন্তান বেঁচে থাকলেও জন্মগত নানা সমস্যায় ভোগে। এর ফলে সন্তান হাবাগোবা হয়, ভালোভাবে কথা বলতে পারে না কিংবা একেবারে বোবা হয়, কানে কম শোনে এবং শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় বামন আকৃতির থেকে যায়।

গর্ভকালীন জটিলতাঃ গর্ভবতী মহিলাদের আয়োডিনের অভাব হলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব, অথবা শিশুর বুদ্ধি ও শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে আয়োডিনের অভাব হলে মা ও শিশুর উভয়ের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য অপরিহার্য, যা ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং শরীরের সামগ্রিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের প্রতিদিন প্রায় 220 মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন গ্রহণ করা প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের চাহিদা বেড়ে যায়, কারণ মায়ের শরীরকে ভ্রূণের থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করতে হয়।

মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার ঝুঁকিঃ আয়োডিনের অভাব শরীরের থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে, যা মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ এবং কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড হরমোন মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের বিকাশে সহায়তা করে। এর অভাব হলে মস্তিষ্কের সঠিক গঠন ও কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষত গর্ভাবস্থায় এবং শিশুদের শৈশবকালীন সময়ে আয়োডিনের অভাব মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আয়োডিনের অভাবে শিখন দক্ষতা ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।

অসংগতি ও বন্ধ্যত্বঃ আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড হরমোন (T3 এবং T4) তৈরি করতে থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট কার্যকর থাকে না। ফলস্বরূপ, শরীর হরমোন উৎপাদন বাড়াতে থাইরয়েড-স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH) নিঃসরণ করে, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে ফুলিয়ে তোলে এবং অসংগতি সৃষ্টি করে। এছাড়াও আয়োডিনের দীর্ঘমেয়াদী অভাবে প্রজনন ক্ষমতায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। এই হরমোনগুলো শরীরের বিপাক, মাসিক চক্র এবং প্রজনন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আয়োডিনের অভাবে হরমোনের ঘাটতি হলে মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে যায় এবং ডিম্বাণু উৎপাদনে বাধা পড়ে। আশা করছি আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয় সে সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

আয়োডিন এর কাজ কি

আয়োডিন এর কাজ হলো মানবদেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা। আয়োডিন মানবদেহের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ, যা বিশেষ করে থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা ও হরমোন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়োডিন গ্রহণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এখানে আয়োডিন এর কাজ কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।

থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করেঃ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থির জন্য অপরিহার্য। এটি থাইরয়েড হরমোন (থাইরক্সিন বা T4 এবং ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন বা T3) তৈরিতে সাহায্য করে। এই হরমোনগুলো শরীরের বিপাকীয় হার (Metabolism) নিয়ন্ত্রণ করে, যা খাবার থেকে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। থাইরয়েড হরমোন শারীরিক বৃদ্ধি এবং স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও বিকাশে সহায়ক। এটি হাড়, মাংসপেশী এবং অন্যান্য কোষের বৃদ্ধি এবং পূর্ণতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করেঃ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থির জন্য অপরিহার্য। এটি থাইরয়েড হরমোন (T3 এবং T4) তৈরিতে সাহায্য করে। থাইরয়েড হরমোন শারীরিক বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি কোষের বৃদ্ধি, হাড়ের গঠন, এবং মাংসপেশীর বিকাশকে প্রভাবিত করে। সঠিক পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন শরীরের সঠিক বিপাকীয় কার্যক্রম নিশ্চিত করে এবং শক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

আয়োডিন মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায় ও শিশুকালে আয়োডিনের অভাব হলে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা দুর্বল হতে পারে, যা মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে আয়োডিন পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে শারীরিক বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশে বাধা পড়তে পারে। এটি বুদ্ধিমত্তার উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। 

গলগণ্ড প্রতিরোধে সহায়তা করেঃ আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গিয়ে গলগণ্ড (goiter) হতে পারে। আয়োডিন গলগণ্ড প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। গলগণ্ড হল থাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত বা অনুচিতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া একটি অবস্থা, যা মূলত আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে ঘটে। 

আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন (T3 এবং T4) তৈরি করতে পারে না। আয়োডিন এই হরমোনগুলির উৎপাদনে সহায়তা করে। সঠিক পরিমাণে আয়োডিন থাকলে, থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদন করতে পারে, যার ফলে গলগণ্ড সৃষ্টি হতে বাধা পায়।সঠিক পরিমাণে আয়োডিন গ্রহণ এই সমস্যাকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নত করেঃ আয়োডিন হরমোন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রজনন ক্ষমতাকে সঠিক রাখতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের অভাব শিশু এবং মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ডের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা মা এবং ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভ্রূণের সঠিক বিকাশে সহায়ক। গর্ভবতী মায়ের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিন গ্রহণ ভ্রূণের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করে এবং গলগণ্ডের মত সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।

ইমিউন সিস্টেম উন্নত করেঃ আয়োডিন ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক কাজকর্মের জন্য অপরিহার্য, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) পরিচালনা এবং সমর্থন করে। আয়োডিনের অভাবে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হতে পারে এবং শরীর বিভিন্ন সংক্রমণ বা রোগের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়তে পারে। আয়োডিনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা শরীরের কোষে ফ্রি র‍্যাডিক্যালস (free radicals) এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (oxidative stress) কমাতে সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস শরীরের কোষকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে সুস্থ রাখে।

আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন (T3 ও T4) উৎপাদনে সহায়তা করে, যা শরীরের বিপাকীয় এবং অন্যান্য সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে রাখে। থাইরয়েড হরমোন শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সঠিক কাজকর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সাদা রক্তকণিকার (white blood cells) কার্যকলাপ এবং ইমিউন রেসপন্স নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। আয়োডিনের জীবাণুনাশক গুণাবলী রয়েছে, যা শরীরকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সহায়তা করে। এটি রক্ত প্রবাহে গিয়ে রোগজীবাণু ধ্বংস করে, যার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

আয়োডিনের অভাবে শিশুদের কোন রোগ হয়

আয়োডিনের অভাবে শিশুদের সাধারণত গলগণ্ড এবং মস্তিষ্কের বিকাশ সমস্যাজনিত রোগ হয়। শুধু তাই নয় আয়োডিনের অভাবে গর্ভাবস্থায় শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে আয়োডিন বঞ্চিত হলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, খর্বকায় হয় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ এবং সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো

১. গলগণ্ডঃ আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য প্রয়োজন। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্রন্থি (thyroid gland) সঠিক পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করতে পারে না। এর ফলে শরীর থাইরয়েড গ্রন্থিকে বড় করে তুলতে থাকে, এবং গলার চারপাশে ফোলাভাব বা গলগণ্ড দেখা দেয়।

লক্ষণঃ আয়োডিনের অভাবে গলার সামনের অংশ ফুলে যায়। যার ফলে শিশুদের শ্বাসকষ্ট বা খাবার গিলতে অসুবিধা হতে পারে। এটি সাধারণত গলায় ফুলে ওঠা হিসেবে দেখা যায়।

২. ক্রিটিনিজমঃ গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে আয়োডিনের অভাব থাকলে নবজাতকের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের অভাব হয়। শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধিতা এবং শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।

লক্ষণঃ শিশুর উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম থাকে। মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি ধীরগতি হয়, ছোট মাথা, হাড়ের গঠন অসম্পূর্ণ ও কথা বলায় দেরি বা সমস্যা হয়।

৩. হাইপোথাইরয়ডিজমঃ আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন কমে যায়। এ হরমোন শরীরের মেটাবলিজম (পাচনক্রিয়া) এবং শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ। 

লক্ষণঃ আয়োডিনের অভাবে শিশুদের ক্ষেত্রে শারীরিক এবং বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুর ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, এবং শেখার সক্ষমতায় সমস্যা হতে পারে।

মানসিক বিকাশের সমস্যাঃ শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশে আয়োডিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।আয়োডিন মস্তিষ্কের স্নায়ুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের বয়সে আয়োডিনের অভাব থাকলে বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়।

লক্ষণঃ আয়োডিনের অভাবে শিশুদের পড়ালেখা শিখতে দেরি হয়, মনোযোগ হারাতে পারে এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে।

স্টান্টেড গ্রোথঃ আয়োডিনের অভাবে শিশুর হাড়ের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে শারীরিক বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়।

লক্ষণঃ গড় উচ্চতা অনুযায়ী বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধি কম হয় ও ওজনও কম হতে পারে।

আয়োডিনের অভাব কেন হয়

আয়োডিনের অভাব কেন হয় তা অনেকেই জানেন না। আয়োডিনের অভাবের কারণ বিশ্লেষণ করলে মূলত পরিবেশগত, খাদ্যাভ্যাস, এবং শারীরিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সামনে আসে।আয়োডিন শরীরের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। এর অভাব হলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিচে আয়োডিনের অভাবের কারণগুলো আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো

১. পরিবেশগত কারণ

  • মাটি ও পানির আয়োডিন ঘাটতিঃ যেসব অঞ্চলের মাটি এবং পানিতে আয়োডিন থাকে না (যেমন পাহাড়ি বা বন্যা-প্রবণ অঞ্চল), সেখানে উৎপাদিত শস্য ও খাবারে আয়োডিনের মাত্রা কম থাকে। পৃথিবীর কিছু অঞ্চলের মাটি আয়োডিনে দরিদ্র। উদাহরণস্বরূপ, পাহাড়ি অঞ্চল (যেমন হিমালয়ের আশপাশ, আন্দিজ, বা আফ্রিকার কিছু এলাকা) এবং বন্যা-প্রবণ সমভূমি এলাকাগুলোর মাটিতে আয়োডিন কম থাকে। ফলে সেখানে উৎপন্ন ফসল ও খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ থাকে অত্যন্ত কম।
  • সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলঃ সামুদ্রিক এলাকায় আয়োডিন বেশি পাওয়া যায় কারণ সমুদ্রের পানি এবং এর জীববৈচিত্র্যে আয়োডিনের উপস্থিতি থাকে। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীরা এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে বঞ্চিত হন।
২. খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টিহীনতা

  • আয়োডিনযুক্ত খাবার না খাওয়াঃ সামুদ্রিক মাছ, শৈবাল, দুগ্ধজাত খাবার, ডিম ইত্যাদিতে আয়োডিন থাকে। এসব খাবারের অনুপস্থিতি খাদ্যাভ্যাসে আয়োডিন ঘাটতির প্রধান কারণ হতে পারে।
  • আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার না করাঃ অনেক দেশে আয়োডিনের অভাব দূর করার জন্য লবণ আয়োডিন দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়। তবে যারা আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করেন না, তারা সহজেই ঘাটতিতে ভুগতে পারেন।
  • গলগোত্রোজেনিক খাবারঃ কিছু খাবার যেমন বাঁধাকপি, শালগম, সয়াবিন, এবং ব্রকলি এমন রাসায়নিক পদার্থ ধারণ করে যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এগুলো বেশি পরিমাণে খাওয়ার ফলে আয়োডিন শোষণ কমে যেতে পারে।
৩. স্বাস্থ্য ও শারীরিক কারণ

  • থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাঃ যদি থাইরয়েড গ্রন্থি দুর্বল হয় বা সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে শরীর আয়োডিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এতে আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা বাড়ে।
  • গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদানঃ গর্ভাবস্থায় নারীদের আয়োডিনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, কারণ ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য থাইরয়েড হরমোন প্রয়োজন। যদি এই চাহিদা পূরণ না হয়, তবে মায়ের শরীরে আয়োডিনের অভাব দেখা দেয় এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
  • শিশু ও কিশোর বয়সে চাহিদা বৃদ্ধিঃ এই বয়সে শরীরের বৃদ্ধি দ্রুত হয়, তাই আয়োডিনের চাহিদা বেশি থাকে। যদি খাদ্যাভ্যাসে আয়োডিন যথেষ্ট না থাকে, তবে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. সামাজিক ও আর্থিক কারণ

  • দারিদ্র্য ও পুষ্টির অভাবঃ দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজলভ্য এবং সস্তা খাদ্যগ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকেন। এতে আয়োডিনের প্রাকৃতিক উৎস, যেমন সামুদ্রিক খাবার বা আয়োডিনযুক্ত লবণ, তাদের খাদ্য তালিকায় থাকে না।
  • সচেতনতার অভাবঃ অনেক মানুষ আয়োডিনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন না থাকায় সাধারণ লবণ ব্যবহার করেন। এতে আয়োডিনের ঘাটতি বাড়ে।
৫. আয়োডিনের চাহিদা পূরণের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা

  • পানি পরিশোধনঃ পানির মাধ্যমে শরীরে আয়োডিন আসতে পারে। তবে পানি পরিশোধনের বিভিন্ন পদ্ধতিতে (যেমন ক্লোরিন বা ফ্লুরাইড ব্যবহারে) আয়োডিনের মাত্রা কমে যেতে পারে।
  • অতিরিক্ত প্রসেস করা খাবারঃ শিল্পজাত খাবারে আয়োডিনের মাত্রা কম থাকে। এগুলো নিয়মিত খেলে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

আয়োডিন যুক্ত খাবার

আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে। থাইরয়েড হরমোনের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আয়োডিন। থাইরয়েড হরমোন আমাদের শরীরের বিপাকসংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন প্রয়োজন।

থাইরয়েড হরমোন প্রধানত মস্তিষ্ক, মাংসপেশি, হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে অপরিহার্য। আমাদের শরীর নিজে আয়োডিন তৈরি করতে পারে না। তাই আমাদের খাবারের সঙ্গে বাইরে থেকে এটা গ্রহণ করতে হয়। আয়োডিনের অভাব পূরণ করতে কোন ধরণের দামী ঔষধ গ্রহণ হতে অধিক কার্যকর উপায় হচ্ছে আয়োডিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ। আয়োডিন যুক্ত খাবার সম্পর্কে নিচে আলোচানা করা হলোঃ

আয়োডিন মূলত মাটি এবং সমুদ্রে পাওয়া যায়। আয়োডিন প্রধাণত প্রাণীজ প্রোটিন, শাকসবজি এবং সামুদ্রিক সামুদ্রিক শৈবাল (নরি, কেল্প, কম্বু, ওয়াকামে) এবং মাছ, শেলফিশ (কড, টিনজাত টুনা, ঝিনুক, চিংড়ি) এছাড়া আয়োডিনযুক্ত খাবার লবণ, দুগ্ধজাত পণ্য (দুধ, পনির, দই) ডিম, গরুর গোশ বা যকৃত ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। মুরগীর মাংস কিছু পরিমাণে রুটিতে এবং দুধের মতো সাধারণ খাবারে পাওয়া যায়। 

যখন আমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দেয় তখন প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন হয় না। ফলে আমরা আয়োডিনের অভাবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগী। বেশির ভাগ আয়োডিন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও পানীয় থেকে পাই। সাধারণত সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। তাই সামুদ্রিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার, যেমন—সমুদ্রের মাছ আয়োডিনসমৃদ্ধ হয়ে থাকে।

কিছু শাক-সবজিতে, যেমন—পালং শাক, বিট আলু, টমেটো ও মরিচে ভালো মাত্রায় আয়োডিন থাকে, যদি সেগুলো আয়োডিনসমৃদ্ধ মাটিতে জন্মে। আবার কিছু সবজি আছে (যেমন—ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম) যেগুলো শরীরে আয়োডিন শোষণে বাধা দেয়। ফলে এসব সবজি বেশি খেলে শরীরে আয়োডিনের মাত্রা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্বাদু পানিতে আয়োডিন খুব বেশি থাকে না। তাই স্বাদু পানির মাছেও আয়োডিন খুব বেশি থাকে না।

প্রতিদিন কতটুকু আয়োডিন গ্রহণ করবেন

প্রতিদিন কতটুকু আয়োডিন গ্রহণ করবেন জানতে এই অংশটুকু পড়ে জানতে পারবেন। আয়োডিন প্রাকৃতিকভাবে মাটি ও পানিতে পাওয়া যায়। যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদ এই মাটি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, তাদের আয়োডিনের চাহিদা এমনিতেই পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত ও বন্যার ফলে মাটি থেকে এই আয়োডিন ধুয়ে চলে যায়, ফলে আমাদের খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতি থেকে যায়।

এই আয়োডিনের ঘাটতি কাটাতে খাদ্যে বাড়তি আয়োডিন নিতে হবে। এর সহজ সমাধান হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ। সামুদ্রিক মাছ, মাছের যকৃতের তেল যেমন কডলিভার তেল, হেলিবার্ড লিভার তেল, শার্ক লিভার তেল, শামুক, সামুদ্রিক উদ্ভিদ এবং ছাগলের দুধে আয়োডিন পাওয়া যায়। আয়োডিন দেহে বেশি পরিমাণে সংরক্ষণ করা যায় না। তাই নিয়মিত এবং পরিমাণমতো আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। 

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১০০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন হলেই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিডনির আয়োডিন নিষ্কাশন করার ক্ষমতা বেশি, ফলে গৃহীত আয়োডিনের ৮০ শতাংশই প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। তাই বিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষের প্রায় ৫০০ মাইক্রোগ্রাম বা ৫ মিলিগ্রাম আয়োডিন প্রতিদিন গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে গর্ভবতী ও শিশুর খাদ্যে অবশ্যই আয়োডিনের পরিমাণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন কতটুকু আয়োডিন গ্রহণ করবেন তা নিচে আলোচনা করা হলোঃ

  • ৬ মাস বয়সী শিশুদের জন্য ১১০ মাইক্রোগ্রাম
  • ৭-১২ মাস বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রস্তাবিত পরিমাণ ১৩০ মাইক্রোগ্রাম
  • ১-৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য ৯০ মাইক্রোগ্রাম
  • ৯-১৩ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী হলে ১২০ মাইক্রোগ্রাম
  • ১৪ বছর হতে প্রাপ্তবয়স্ক হলে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম
  • গর্ভবতী মহিলা হলে ২২০ মাইক্রোগ্রাম ২০ মিলিগ্রাম

আয়োডিনের অভাবজনিত রোগের লক্ষণ

আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার এবং আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য, সামুদ্রিক শৈবাল খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়োডিনের অভাব শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের এবং শিশুদের জন্য এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিলে নিচের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়ঃ

  • শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগা
  • মুখ ফুলে যাওয়া
  • চুল পাতলা হয়ে যাওয়া
  • হাড়ের সন্ধিস্থলে ব্যথা হওয়া
  • মাংশপেশি নড়াচড়ায় কষ্ট হওয়া
  • গলার সামনের অংশে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়। এটি আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড হরমোন সঠিক পরিমাণে উৎপন্ন না হওয়ার কারণে ঘটে। ফলে শ্বাস নিতে ও খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।
  • মস্তিষ্কের নিউরোনাল কার্যক্রম সঠিকভাবে কাজ করতে আয়োডিন প্রয়োজন। এর অভাবে ব্রেন ফাংশন দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায় ও কোন কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়।
  • শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু স্বাভাবিক উচ্চতা ও ওজন অর্জন করতে পারে না। এক্ষেত্রে হাঁটা-চলা, কথা বলা, বুদ্ধিমত্তা বা অন্য বিষয় শেখার ক্ষমতার অভাব সৃষ্টি হয়।
  • আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মায়েদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা গর্ভজাত শিশুর বিকাশে প্রভাব ফেলে। যার ফলে গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসব ও শিশুর মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না।
  • অতিরিক্ত আয়োডিনের ঘাটতি হলে মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
  • আয়োডিনের অভাবে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে যা ঋতুচক্র অনিয়মিত হওয়া, গর্ভধারণে সমস্যা বা বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দেয়।

আয়োডিনের ঘাটতি রোধে করণীয়

আয়োডিনের ঘাটতি রোধে করণীয় বা সবচেয়ে সাধারণ এবং পরামর্শযোগ্য পদ্ধতি হলো আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। আয়োডিন শরীরের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খনিজ, যা থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। এর অভাব বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন গলগণ্ড, হাইপোথাইরয়েডিজম, এবং গর্ভাবস্থায় শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সমস্যা। আয়োডিনের ঘাটতি রোধে করণীয় নিচে তুলে ধরা হলোঃ

আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারঃ আয়োডিনের ঘাটতি রোধে রান্নার জন্য আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা একটি সহজ এবং কার্যকর উপায়। প্রতিদিন রান্নার লবণ হিসেবে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করলে শরীরের আয়োডিনের চাহিদা পূরণ সহজ হয়। বাজার থেকে লবণ কেনার সময় নিশ্চিত করুন যে এটি আয়োডিনযুক্ত কি না। প্রতিদিন প্রায় ৫ গ্রাম লবণ খাওয়া নিরাপদ (সোডিয়ামের চাহিদার উপর নির্ভর করে)।

আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াঃ আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার আমাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন এবং বিভিন্ন শারীরিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার যেমনঃ- 

  • সামুদ্রিক মাছ, স্যামন, টুনা, কড ফিশ, সার্ডিন। শেলফিশ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক। সামুদ্রিক শৈবাল, যেমন নরি, ওয়াকামে, এবং কেল্প। 
  • গরুর দুধ এবং এর থেকে তৈরি পণ্য যেমন দই, মাখন, এবং পনির। 
  • কিছু ফল ও সবজিতে আয়োডিন থাকে যেমনঃ স্ট্রবেরি, পালং শাক ও ব্রকলি।
  • গরুর মাংস এবং মুরগির ডিম ও মাংসে আয়োডিন সামান্য পরিমাণে থাকে।
আয়োডিনের এই ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার জন্য আমাদের অবশ্যই খাদ্যের সঙ্গে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। এর সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উপায় হলো আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া। আয়োডিনযুক্ত লবণ শুষ্ক স্থানে, সূর্যের আলো থেকে দূরে এবং আবদ্ধ পাত্রে রাখতে হবে। নতুবা লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যাবে।

এছাড়াও আমরা যেসব খাবার থেকে আয়োডিন পেতে পারি যমন,  ১/৪ চা চামচ লবণ থেকে মিলে ৯৫ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন, ১ পিস সামুদ্রিক মাছে ৬৫০ মাইক্রোগ্রাম, ১ টা কলায় ৩ মাইক্রোগ্রাম, ১ টা বড় ডিমে ১২ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন পাওয়া যায়। এছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া, মাংস, সমুদ্রের সবরকম মাছ ও অন্যান্য সি ফুড আর দুধেও আয়োডিন পাওয়া যায়।

আমরা অনেকেই জানি না কোন খাবারে কি পুষ্টিগুণ রয়েছে। আয়োডিনের প্রধান উত্‍স হলো সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী। আয়োডিনের অভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য আয়োডিন যুক্ত লবণ ও সামুদ্রিক মাছ খাওয়া দরকার। যদি খাদ্যাভ্যাস থেকে পর্যাপ্ত আয়োডিন না পাওয়া যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে আয়োডিন সম্পূরক গ্রহণ করা যেতে পারে।

আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে যা খাবেন

আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে যা খাবেন তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আর্টিকেলের নিম্নাংশে।মানবদেহে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বা ইংরেজিতে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিলে প্রয়োজনীয় থাইরোয়েড হরমোন উৎপন্ন হয় না। ফলে যখন শরীরে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না তখন তাকে হাইপোথাইরয়ডিজম বলা হয়।

এর ফলে আলসেমির ভাব, ঠাণ্ডা সহ্য করতে অক্ষমতা, অনিদ্রা, চামড়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়া শরীরে আয়োডিনের অভাব হলে, হাইপোথাইরয়েডিজম, অটো ইমিউন ডিজিজ, গলগণ্ড ইত্যাদি সমস্যা হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না আয়োডিনের সমস্যা হলে কী খাবার খাবেন। জেনে নিন, আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবারের নাম, যা আপনার শরীরে আয়োডিনের অভাব পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

দুধঃ দুধ শরীরে আয়োডিনের অভাব পূরণ করতে সাহায্য করে। গরুর দুধে প্রচুর আয়োডিন থাকে। আয়োডিন ছাড়াও দুধে রয়েছে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম। তাই প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খেতে আপনার আয়োডিনের অভাব পূরণ হবে।

ডিমঃ আমরা কমবেশি সবাই ডিম খেয়ে থাকি। কিন্তু জানেন কি ডিমে আছে প্রচুর পরিমানে আয়োডিন। একটি সিদ্ধ ডিমের মধ্যে ১২ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন রয়েছে। আয়োডিনের চাহিদা পূরণে ডিম খেতে পারেন। প্রতিদিন একটি ডিম খেলে শরীরের প্রয়োজনীয় আয়োডিনের অংশ মেটানো যায়।

চিংড়ি মাছঃ চিংড়ি মাছ মজাদার একটি খাবার ও আয়োডিনের ভালো উৎস বটে। চিংড়ি মাছ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আরো প্রয়োজনীয় মিনারেলের চাহিদা পূরণ করে। তিন আউন্স চিংড়িতে রয়েছে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন।

দইঃ দই খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। এক কাপ দইয়ের মধ্যে রয়েছে ১৫৪ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন। আয়োডিনের চাহিদা পূরণে তাই খাদ্যতালিকায় দইও রাখতে পারেন। বিশেষ করে গ্রিক দই বা পূর্ণ ফ্যাটযুক্ত দই আয়োডিনের ভালো উৎস। এর পরিমাণ নির্ভর করে দুধের উৎস এবং খাদ্যের ধরন (যেমন গরুর দুধ বা ছাগলের দুধ থেকে তৈরি দই) এর ওপর। সাধারণত, গরুর দুধে আয়োডিনের পরিমাণ বেশি থাকে।

শাকসবজিঃ শাকসবজিতে সাধারণত সামান্য পরিমাণ আয়োডিন থাকে। তবে কিছু নির্দিষ্ট শাকসবজি যেমন, পালং শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, শালগম পাতা, সবুজ মটরশুঁটি, মিষ্টি আলু, গাজর ইত্যাদিতে তুলনামূলকভাবে বেশি আয়োডিন সরবরাহ করে। এইসব শাকসবজিগুলো আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে যদি অন্যান্য আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবারের সাথে এগুলো খাওয়া হয়। 

ফলমূলঃ ফলমূল সাধারণত আয়োডিনের প্রধান উৎস নয়, তবে কিছু ফল তুলনামূলকভাবে সামান্য পরিমাণ আয়োডিন সরবরাহ করতে পারে। বিশেষ করে এমন ফল যেগুলো সমুদ্রের কাছাকাছি মাটি বা আয়োডিনযুক্ত এলাকায় জন্মায়, সেগুলোতে আয়োডিনের পরিমাণ বেশি হতে পারে যেমন, স্ট্রবেরি, কলা, ক্র্যানবেরি, আনারস, আম, খেজুর, পিচফল, জলপাই ইত্যাদি। ফলমূল সাধারণত আয়োডিনের উচ্চমাত্রার উৎস না হলেও এগুলো শরীরকে আয়োডিনের সামান্য চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে।

শেষকথা

আজকের আলোচনার মূল বিষয় ছিলো আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয়। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা যায় এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। আয়োডিন শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক, বিশেষ করে থাইরয়েড হরমোনের মাধ্যমে শরীরের বিপাকীয় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এটি গর্ভবতী মায়েদের জন্য জরুরি, কারণ ভ্রূণের সঠিক মস্তিষ্কের গঠন এবং শিশুর বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক বৃদ্ধি আয়োডিনের উপর নির্ভরশীল।

আয়োডিনের অভাবজনিত রোগের প্রকোপ যতটা ভয়াবহ, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ততোধিক সহজ। আপনার প্রতিদিনের খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত এক চিমটি লবণ আপনার দেহে আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে সহায়তা করবে। তা সত্ত্বেও আপনি যদি মনে করেন আপনার আয়োডিনের ঘাটতি আছে, অথবা কোন লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তাহলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আশা করছি আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url