থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পুরো আর্টিকেল মনোযোগ দিয়ে
পড়তে হবে।থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্ত রোগ, যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ত্রুটির
কারণে হয়। হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকায় অবস্থিত একটি প্রোটিন, যা অক্সিজেন
পরিবহনে সাহায্য করে। থ্যালাসেমিয়া রোগের মূল কারণ হলো জিনগত, যা হিমোগ্লোবিনের
আলফা বা বিটা গ্লোবিন চেইনের উৎপাদনকে ব্যাহত করে।
থ্যালাসেমিয়া একটি অটোজোমাল রিসেসিভ রোগ, অর্থাৎ এই রোগটি তখনই প্রকাশ পায়, যখন
শিশু তার বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন পায়। যদি বাবা বা মা একজন বাহক
হন, তবে সন্তান বাহক হতে পারে, কিন্তু রোগী হবে না। যদি বাবা-মা উভয়েই বাহক হন,
তবে সন্তানের গুরুতর থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পোস্ট সূচিপত্রঃ থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
- থ্যালাসেমিয়া কি
- থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ
- থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ
- থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রকারভেদ
- থ্যালাসেমিয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি
- থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিকার
- থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের যত্ন
- থ্যালাসেমিয়া রোগীর খাবার তালিকা
- থ্যালাসেমিয়া রোগী যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
- শেষকথাঃ থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
থ্যালাসেমিয়া কি
থ্যালাসেমিয়া মূলত জিনগত বা বংশগত রক্তজনিত রোগ, যা হিমোগ্লোবিন তৈরির
প্রক্রিয়ায় ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকার (Red Blood
Cells) প্রধান উপাদান, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে।
থ্যালাসেমিয়া হলে শরীর পর্যাপ্ত বা কার্যকরী হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না,
যার ফলে রক্তস্বল্পতা (Anemia) সৃষ্টি হয়। হিমোগ্লোবিন হলো লোহিত রক্তকণিকার
এক গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
আরও পড়ুনঃ বাচ্চাদের মুখে ঘা হলে করণীয়
এটি সাধারণত বাবা-মায়ের জিনের মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয়। যদি কোনো
ব্যক্তি তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন পায়, তাহলে তার
থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। থ্যালাসেমিয়া গুরুতর কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য
রোগ যা সচেতনতা, সঠিক পরীক্ষা এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। যারা এই রোগের বাহক, তাদের অবশ্যই
বিয়ের আগে পরীক্ষা করানো উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই রোগ থেকে রক্ষা করা
যায়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ
থ্যালাসেমিয়া রোগের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তজনিত
রোগ, যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ত্রুটি থাকার কারণে হয়। এটি বাবা-মায়ের থেকে
সন্তানের মধ্যে চলে আসে এবং রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে। এই রোগটি তখনই হয়, যখন
হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য দায়ী জিনগত পরিবর্তন ঘটে এবং লোহিত রক্তকণিকা
স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। নিচে থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো।
১. জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশনঃ থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রধান
কারণ হলো জিনগত ত্রুটি। থ্যালাসেমিয়া রোগ HBB (Beta-globin) ও HBA1, HBA2
(Alpha-globin) জিনের মিউটেশনের কারণে হয়। এই মিউটেশন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন
চেইন তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে
না এবং সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়। আলফা থ্যালাসেমিয়া হয় যদি HBA1 এবং HBA2
জিনের সমস্যার কারণে আলফা গ্লোবিন চেইন তৈরি কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
বিটা থ্যালাসেমিয়া হয় যদি HBB জিনের পরিবর্তনের ফলে বিটা গ্লোবিন চেইন
উৎপাদন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
২. বংশগত সংক্রমণঃ থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত (genetic) এবং
অটোজোমাল রিসেসিভ (autosomal recessive) রোগ, যা বাবা-মায়ের কাছ থেকে
সন্তানের শরীরে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ, শিশু তখনই থ্যালাসেমিয়ায়
আক্রান্ত হয়, যখন সে উভয় পিতা-মাতার কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন
পায়।থ্যালাসেমিয়া রোগ অটোজোমাল রিসেসিভ ধাঁচে বংশপরম্পরায় ছড়ায়। এর অর্থ
হলো—একজন ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র একজন অভিভাবকের কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন
পায়, তবে সে বাহক (Carrier) হবে, কিন্তু রোগে আক্রান্ত হবে না। যদি উভয়
পিতা-মাতা থ্যালাসেমিয়া বাহক হন, তবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত
হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৩. হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ত্রুটিঃ হিমোগ্লোবিন হলো লোহিত রক্তকণিকার
(RBC) প্রধান উপাদান, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে।
হিমোগ্লোবিন গঠিত হয় গ্লোবিন প্রোটিন চেইন ও হেম (Heme) উপাদান দ্বারা।
থ্যালাসেমিয়া রোগে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ত্রুটি দেখা দেয়, যার ফলে
রক্তস্বল্পতা (Anemia), লোহিত রক্তকণিকার ভঙ্গুরতা এবং শরীরে অক্সিজেন
পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হয়। হিমোগ্লোবিন মূলত দুটি ধরনের প্রোটিন চেইন দ্বারা
গঠিতঃ
- আলফা গ্লোবিন চেইনঃ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনের জন্য HBA1 ও HBA2 জিন দায়ী। যদি এই জিনগুলোর একটি বা একাধিক কপি হারিয়ে যায় (Deletion Mutation), তাহলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা গ্লোবিনের অভাবে অকার্যকর হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, যা সহজেই নষ্ট হয়ে যায়।
- বিটা গ্লোবিন চেইনঃ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনের জন্য HBB জিন দায়ী। যদি এই জিনের পরিবর্তন হয় (Point Mutation বা Deletion), তাহলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। এতে বিটা গ্লোবিন চেইন তৈরি কমে যায় বা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
যদি কোনো একটি চেইন পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি না হয়, তাহলে থ্যালাসেমিয়া দেখা
দেয়। আলফা গ্লোবিন বা বিটা গ্লোবিনের অভাবে লোহিত রক্তকণিকা দুর্বল হয়ে
যায় এবং ভেঙে পড়ে। শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে ব্যাঘাত ঘটে, ফলে গুরুতর
অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।
৪. থ্যালাসেমিয়া বহনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিঃ থ্যালাসেমিয়া বংশগত
রক্তস্বল্পতা রোগ, যা বাবা-মায়ের জিনগত ত্রুটির কারণে সন্তানের মধ্যে
স্থানান্তরিত হয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫-৭% মানুষ থ্যালাসেমিয়া বহনকারী, এবং
কিছু দেশে এই হার আরও বেশি যেমন- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড,
গ্রিস, ইতালি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়া বহনকারীর সংখ্যা
দ্রুত বাড়ছে। থ্যালাসেমিয়া বহনকারীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ অজ্ঞতা, বংশগত
সংক্রমণ, বিবাহের আগে পরীক্ষা না করা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অভাব। এটি
নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, জেনেটিক পরীক্ষা ও সরকারের কার্যকর
নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ সাধারণত রোগের ধরন ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে।
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ, অর্থাৎ এটি পিতা-মাতার মাধ্যমে সন্তানের শরীরে
আসে। যদি বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া মাইনরের বাহক হন, তবে তাদের সন্তান
থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকিতে থাকে। কোন ধরনের থ্যালাসেমিয়া
হলে কী পরিমাণ হিমোগ্লোবিন উৎপাদন ব্যাহত হয়, তার উপর ভিত্তি করে লক্ষণগুলো
প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুনঃ অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ ও চিকিৎসা
১. থ্যালাসেমিয়ার সাধারণ লক্ষণঃ থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত
রক্তের রোগ, যা হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনে ত্রুটি ঘটায় এবং ফলে রক্তস্বল্পতা
(অ্যানিমিয়া) হয়। থ্যালাসেমিয়ার সাধারণ লক্ষণগুলো রোগের ধরণ (আলফা বা বিটা
থ্যালাসেমিয়া) ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ প্রায় সকল
থ্যালাসেমিয়া রোগীর মধ্যে দেখা যায়ঃ
- রক্তস্বল্পতাঃ থ্যালাসেমিয়া রোগে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি ঘটে। হিমোগ্লোবিন রক্তের লোহিত কণিকার মধ্যে অক্সিজেন বহন করে, এবং হিমোগ্লোবিন কম থাকলে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে রক্তস্বল্পতা (Anemia) দেখা দেয়, যা ক্লান্তি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট এবং অবসাদ সৃষ্টি করে।
- ত্বকের ফ্যাকাশে বা হলদে হওয়াঃ থ্যালাসেমিয়ায় রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায়, যার ফলে শরীরে রক্তের সঠিক পরিবহন কমে যায়। এতে ত্বক ফ্যাকাশে বা হলদে হতে পারে, বিশেষত যাদের বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর থাকে, তাদের মধ্যে এই লক্ষণ বেশি দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলদেটে ভাবও দেখা যায়, যা জন্ডিস (Jaundice) বলে পরিচিত।
- প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধিঃ থ্যালাসেমিয়া রোগী যখন রক্ত তৈরি করতে ব্যর্থ হন বা রক্তকণিকা দ্রুত ধ্বংস হয়, তখন শরীরের প্লীহা (Spleen) এবং যকৃত (Liver) অতিরিক্ত কাজ করতে থাকে এবং আয়রন বা অন্যান্য উপাদান সংরক্ষণ করতে পারে, যার ফলে এই অঙ্গ দুটি বৃদ্ধি পায়। ফলে পেটের বাম পাশে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়।
- হাড়ের বিকৃতিঃ হিমোগ্লোবিনের অভাবে অস্থিমজ্জা (Bone Marrow) অত্যাধিক কাজ করে, যাতে হাড়ের গঠন পরিবর্তিত হতে পারে। বিশেষ করে মুখমণ্ডল, কপাল এবং পাঁজরের হাড় বড় হয়ে যেতে পারে। এটি মূলত বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
- হৃদপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দনঃ থ্যালাসেমিয়া রোগে শরীরের রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে, যার কারণে হৃদযন্ত্র দ্রুত কাজ করতে থাকে। এর ফলে হার্টের স্পন্দন দ্রুত হতে পারে (Tachycardia)। দীর্ঘ সময় ধরে এটি হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেনের অভাবের কারণে শ্বাসকষ্ট অনুভব করা।
- শ্বাসকষ্টঃ রক্তে অক্সিজেন কম থাকলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। রোগীর শরীর সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না, শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে পারে এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে।
- তাপমাত্রা পরিবর্তনঃ থ্যালাসেমিয়া রোগে শরীরের আয়রন জমে যেতে পারে, যা বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপ অনুভব বা ঠাণ্ডা অনুভূতি হতে পারে।
২. থ্যালাসেমিয়া মেজরের লক্ষণসমূহঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরের লক্ষণ
সাধারণত শৈশব থেকেই শুরু হয় এবং এর লক্ষণগুলি গুরুতর হতে পারে। এই রোগের
লক্ষণগুলি রক্তস্বল্পতা (Anemia) থেকে শুরু করে হাড়ের বিকৃতি, প্লীহা ও
যকৃতের বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- গুরুতর রক্তস্বল্পতাঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরের প্রধান লক্ষণ হলো গুরুতর রক্তস্বল্পতা। রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা অক্সিজেন পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে এবং শরীরে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। এর ফলে রোগীকে ক্লান্তি, দুর্বলতা, এবং অবসাদ অনুভূত হতে পারে।
- ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলদে হওয়াঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরে রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যাওয়ার কারণে জন্ডিস (Jaundice) দেখা দিতে পারে। এতে ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়, কারণ বিলিরুবিন নামে একটি পদার্থ শরীরে জমে যায়।
- প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধিঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরে, রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং শরীরের প্লীহা (Spleen) ও যকৃত (Liver) অতিরিক্ত কাজ করে, যার ফলে এরা বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি পেটের বাম দিকে ব্যথা বা চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- হাড়ের বিকৃতিঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরের রোগী তাদের হাড়ের গঠন পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। রক্তকণিকা তৈরির জন্য অস্থিমজ্জা অতিরিক্ত কাজ করার ফলে হাড়ের গঠন বিকৃত হতে পারে, বিশেষত মুখ, কপাল, পাঁজর ও অন্যান্য হাড়ে।
- হৃদযন্ত্রের সমস্যাঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরের কারণে শরীরে অক্সিজেনের অভাবের ফলে হৃদযন্ত্র অতিরিক্ত কাজ করতে পারে, যার ফলে হার্টের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে হার্টের অতিরিক্ত স্পন্দন, হার্ট ফেইলিউর ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- রমোনাল সমস্যাঃ থ্যালাসেমিয়া মেজরের কারণে বিভিন্ন হরমোনাল সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন গ্রোথ হরমোনের অভাব, থাইরয়েড সমস্যা, এবং গনাডাল ডিসফাংশন (যেমন পুরুষ বা মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব)।
- আয়রন জমে যাওয়াঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের নিয়মিত রক্ত ট্রান্সফিউশন করতে হয়, যার ফলে শরীরে আয়রন অতিরিক্ত জমে যেতে পারে। এই অতিরিক্ত আয়রন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, বিশেষ করে হৃদযন্ত্র, যকৃত এবং অস্তিরজ্জা।
৩. থ্যালাসেমিয়া মাইনরের লক্ষণঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনরের রোগীদের
অনেক সময় তেমন লক্ষণ থাকে না বা লক্ষণগুলি খুবই হালকা থাকে। তবে কিছু কিছু
রোগী হালকা রক্তস্বল্পতা (anemia) বা শরীরে অক্সিজেনের অভাব অনুভব করতে পারে।
কিছু সাধারণ লক্ষণ এখানে তুলে ধরা হলোঃ
- হালকা রক্তস্বল্পতাঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনরের রোগীদের রক্তস্বল্পতা সাধারণত হালকা হয়। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ একটু কম থাকলেও, তা অনেক সময় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে না। তবে, কিছু রোগী ক্লান্তি, দুর্বলতা বা অবসাদ অনুভব করতে পারেন।
- ত্বক ফ্যাকাশে হওয়াঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনরের কিছু রোগী ত্বকে ফ্যাকাশে বা হালকা হওয়া অনুভব করতে পারেন, যা রক্তস্বল্পতার কারণে ঘটে।
- শরীরের কোনো গুরুতর সমস্যা না হওয়াঃ বেশিরভাগ থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগীর কোনো গুরুতর সমস্যা থাকে না। তারা সাধারণত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন এবং জীবনযাত্রায় বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হন না।
- পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া মেজর থাকতে পারেঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর বংশগত রোগ হওয়ায়, এই রোগের লক্ষণ যদি কোন সদস্যে দেখা না যায়, তবে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা থ্যালাসেমিয়া মাইনর থাকতে পারে। থ্যালাসেমিয়া মাইনরকে কখনো কখনো থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার বলা হয়, কারণ এটি একজন ব্যক্তি পরবর্তী প্রজন্মে গর্ভধারণের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে।
- কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে তেমন লক্ষণ না থাকাঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর অনেক সময় এতটাই মৃদু হয় যে রোগী নিজেও বুঝতে পারে না যে তার থ্যালাসেমিয়া মাইনর আছে। পরীক্ষা ছাড়া অনেক সময় এটি শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। আশা করি, থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ গুলো জানতে পেরেছেন।
থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রকারভেদ
থ্যালাসেমিয়া রোগের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যা তার গুরুতরতা, লক্ষণ, এবং
চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তের রোগ,
যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদন করতে সহায়তা করা একটি বিশেষ প্রোটিনের ত্রুটি থেকে
ঘটে। থ্যালাসেমিয়া প্রধানত বিটা গ্লোবিন এবং আলফা গ্লোবিন চেইনে ত্রুটির
কারণে হয়ে থাকে। নিচে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রকারভেদগুলোর বিস্তারিত আলোচনা
করা হলো।
আরও পড়ুনঃ শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা
১. আলফা থ্যালাসেমিয়াঃ থ্যালাসেমিয়ার এই প্রকারটি আলফা গ্লোবিন চেইনে ত্রুটির
কারণে হয়ে থাকে। এটি সাধারণত এশীয়, আফ্রিকান এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লোকদের
মধ্যে বেশি দেখা যায়। আলফা থ্যালাসেমিয়া চারটি অ্যালিল বা জিন দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত। আলফা থ্যালাসেমিয়ার চারটি ধরণ রয়েছেঃ
- আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনরঃ এটি আলফা গ্লোবিনের একটি জিনে ত্রুটি থাকলে ঘটে, এবং সাধারণত কোনো গুরুতর লক্ষণ বা সমস্যা সৃষ্টি হয় না। রক্তস্বল্পতা হতে পারে তবে তা খুবই হালকা এবং রোগী সাধারণত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
- হিমোগ্লোবিন এইচ ডাইজিসঃ এটি তখন ঘটে যখন আলফা গ্লোবিনের তিনটি জিনে ত্রুটি থাকে। এতে কিছু গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন: ক্লান্তি, রক্তস্বল্পতা, এবং প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি। এর চিকিৎসার জন্য রক্ত সংযোজন বা অন্যান্য চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
- আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজরঃ এটি খুব গুরুতর একটি অবস্থা, যা তখন ঘটে যখন আলফা গ্লোবিনের সব চারটি জিনে ত্রুটি থাকে। এই অবস্থায় থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণগুলি গুরুতর হতে পারে, এবং রোগীকে ব্রড রক্তসংযোজনের প্রয়োজন হতে পারে। এটি একটি জীবনসংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে এবং গুরুতর শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
২. বিটা থ্যালাসেমিয়াঃ বিটা থ্যালাসেমিয়া বিটা গ্লোবিন চেইনে
ত্রুটির কারণে ঘটে। এটি সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং
আফ্রিকা অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া বিটারও তিনটি প্রধান প্রকার
রয়েছে যেমনঃ
- থ্যালাসেমিয়া মাইনরঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর (বা থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার) তখন ঘটে যখন একটি বিটা গ্লোবিন জিনে ত্রুটি থাকে। রোগীর রক্তস্বল্পতা খুবই হালকা হয় এবং সাধারণত রোগী কোনো গুরুতর সমস্যা অনুভব করেন না। তবে, তারা থ্যালাসেমিয়া মেজর বা অন্যান্য প্রজন্মে এই রোগটি সংক্রমণ করতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়াঃ থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া তখন ঘটে যখন দুটি বিটা গ্লোবিন জিনে ত্রুটি থাকে, তবে সেই ত্রুটিগুলি খুব গুরুতর হয় না। এই অবস্থায়, রোগীকে কিছু চিকিৎসা বা রক্ত সংযোজনের প্রয়োজন হতে পারে, তবে এটি একটি হালকা ও মাঝারি ধরনের রোগ।
- থ্যালাসেমিয়া মেজরঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর, যা বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর নামে পরিচিত, তখন ঘটে যখন দুটি বিটা গ্লোবিন জিনে গুরুতর ত্রুটি থাকে। এই রোগীকে রক্ত সংযোজন এবং অন্যান্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এটি একটি গুরুতর রক্তের রোগ এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি
থ্যালাসেমিয়ার ঝুঁকি সবার জন্য সমান নয়, এটি মূলত বংশগত, জাতিগত, এবং ভৌগলিক
কারণে বেশি হতে পারে। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয়, দক্ষিণ এশীয়, আফ্রিকান, এবং
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি। এই রোগটি খুবই
সাধারণভাবে জিনগত কারণে ছড়ায়, বিশেষ করে যাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে
থ্যালাসেমিয়া ছিল। থ্যালাসেমিয়ার ঝুঁকি নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ের উপর। বিস্তারিতভাবে এই ঝুঁকির কারণ এবং প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা
হলো।
আরও পড়ুনঃ জিকা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ ও প্রতিরোধ
১. বংশগত (জেনেটিক) ঝুঁকিঃ থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রোগ, যা
ডিএনএ বা জিনে পরিবর্তনের কারণে হয়। যদি একজন ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়ার
ক্যারিয়ার বা মাইনর হন, অর্থাৎ তাদের একটি থ্যালাসেমিয়া জিন থাকে, তবে তাদের
সন্তানের মধ্যে এই রোগ হতে পারে। তবে, থ্যালাসেমিয়া মেজর বা গুরুতর রূপে দেখা
দেয় যখন দুইজন থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ক্যারিয়ার) ব্যক্তি সন্তান ধারণ করেন।
- থ্যালাসেমিয়া মাইনরঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর একধরনের ক্যারিয়ার অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তির একটি বিটা বা আলফা গ্লোবিন জিনে ত্রুটি থাকে। এই ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত কোনও গুরুতর লক্ষণ অনুভব করেন না, তবে তারা থ্যালাসেমিয়া জিনটি পরবর্তী প্রজন্মে পাস করতে পারেন।
- থ্যালাসেমিয়া মেজরঃ যদি একজন ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং তাদের সঙ্গীও থ্যালাসেমিয়া মাইনর হন, তাহলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার ঝুঁকি থাকে। থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীর রক্তস্বল্পতা এবং শারীরিক জটিলতার কারণে নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
২. জাতিগত গোষ্ঠী ও ভৌগলিক অবস্থানঃ থ্যালাসেমিয়া বিশ্বের কিছু
নির্দিষ্ট জাতিগত গোষ্ঠী ও অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এটি একটি বংশগত রোগ হওয়ায়,
বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে জিনগত ভাবে এটি বেশি ছড়িয়ে পড়ে। নিচে কিছু
জাতিগত গোষ্ঠী ও অঞ্চল উল্লেখ করা হলো, যেখানে থ্যালাসেমিয়ার ঝুঁকি বেশি
থাকেঃ
- ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলঃ ইতালি, গ্রিস, কিপ্রস, মালটা, তুরস্ক এবং অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং মাইনর খুবই সাধারণ। এখানে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের হার অনেক বেশি এবং এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বংশগতভাবে থ্যালাসেমিয়া ছড়িয়ে পড়েছে।
- দক্ষিণ এশিয়াঃ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং বুরুন্ডিসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মধ্যে থ্যালাসেমিয়া একটি ব্যাপক সমস্যা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় জনগণের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং মেজর অনেক বেশি দেখা যায়।
- আফ্রিকাঃ আফ্রিকান জনগণের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া মাইনরের সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এটি একটি সাধারণ রোগ। থ্যালাসেমিয়া মাইনরের সঙ্গে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের সম্পর্ক থাকতে পারে, কারণ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অঞ্চলের কিছু মানুষ থ্যালাসেমিয়া মাইনর বহন করে, যা তাদের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে।
- মধ্যপ্রাচ্যঃ সৌদি আরব, ইরান, আফগানিস্তান, লেবানন এবং আরব উপসাগরীয় দেশগুলির জনগণের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বেশি পাওয়া যায়। এখানে অনেক মানুষ থ্যালাসেমিয়া মাইনরের বাহক, এবং বংশগতভাবে থ্যালাসেমিয়ার রক্তস্বল্পতা থাকতে পারে।
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াঃ চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স সহ অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির জনগণের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বেশি পাওয়া যায়। থ্যালাসেমিয়ার এই প্রভাব সেখানে অনেক বেশি, এবং বিশেষত থ্যালাসেমিয়া মাইনর বাহকদের মধ্যে কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা যায়।
৩. থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ক্যারিয়ার) এবং মেজরঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর
বা ক্যারিয়ার (যাদের একটিতে থ্যালাসেমিয়া জিন থাকে) তাদের সন্তানের মধ্যে
থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যদি তাদের জীবনসঙ্গীও থ্যালাসেমিয়া
মাইনর হন। এর ফলস্বরূপ, সন্তান গুরুতর রক্তস্বল্পতা (থ্যালাসেমিয়া মেজর) বা
অন্য কোনো সমস্যা সম্মুখীন হতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়া মাইনরঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত কোনো বড় লক্ষণ অনুভব করেন না, তবে তারা থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করেন এবং পরবর্তী প্রজন্মে এটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। যদি একজন ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া মাইনর হন এবং তাদের সঙ্গীও থ্যালাসেমিয়া মাইনর হন, তবে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া মেজর বা গুরুতর রক্তস্বল্পতায় ভুগতে পারে। এটি তখন একটা গুরুতর অবস্থা সৃষ্টি করে।
- থ্যালাসেমিয়া মেজরঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর, যাকে ক্ল্যাসিক থ্যালাসেমিয়া বলা হয়, এটি এক ধরনের গুরুতর রক্তস্বল্পতা যা তখন ঘটে যখন একজন ব্যক্তি দুটি থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করে। এই রোগীরা সাধারণত জন্মের পর থেকেই চিকিৎসা প্রাপ্ত হন এবং তাদের জীবনযাপনে নিয়মিত রক্তসংযোজন এবং আয়রন চেলেটিং থেরাপি প্রয়োজন হয়।
৪. বংশগত পরীক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকি নির্ধারণঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর
বা ক্যারিয়ার পরিদর্শন করার জন্য জেনেটিক স্ক্রীনিং এবং হেমোগ্লোবিন
ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা যেতে পারে। গর্ভধারণের আগে
বা গর্ভাবস্থায় স্ক্রীনিং করা হলে জানা যাবে যে, মা ও বাবা থ্যালাসেমিয়া
মাইনর বা ক্যারিয়ার কিনা এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা বা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া
যাবে।
৫. ঝুঁকির অন্যান্য কারণঃ কোনো নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর
মধ্যে অধিকাংশ সদস্যের থ্যালাসেমিয়া থাকলে, সেখানে নতুন সদস্যের জন্য
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। থ্যালাসেমিয়া মাইনর বাহকরা যদি
তাদের সন্তানের সঙ্গে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বাহককে বিয়ে করেন, তবে তাদের সন্তান
থ্যালাসেমিয়া মেজর হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিকার
থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিকার বা চিকিৎসা নির্ভর করে রোগটির ধরন এবং রোগীর
শারীরিক অবস্থার ওপর। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ, যার জন্য বর্তমানে
পুরোপুরি নিরাময়ের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা
রোগীদের জীবনের গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে এবং রোগের লক্ষণগুলি
নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। নিচে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিকার সম্পর্কে
বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ।
রক্ত সংযোজনঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর বা গুরুতর থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
জন্য রক্ত সংযোজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত রক্ত সংযোজন তাদের শরীরে
হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং রক্তস্বল্পতার সমস্যা
সমাধান করে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে রক্ত সংযোজনের ফলে শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমে
যেতে পারে, যা নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, আয়রন নিয়ন্ত্রণে রাখার
জন্য আরো কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয় (যেমন আয়রন চেলেটিং থেরাপি)।
আয়রন চেলেটিং থেরাপিঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের রক্ত সংযোজনের
ফলে শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমে যায়। এটি লিভার, হৃদপিণ্ড, যকৃত ও অন্যান্য
অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। আয়রন চেলেটিং থেরাপি এই অতিরিক্ত আয়রন বের করে শরীর
থেকে। এই থেরাপি বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে করা হয়, যেমন ডিফেরাসিরক্স
(Deferasirox), ডিফেরাসপিরামিন (Deferiprone), ডিফেরাসোমাইন (Deferoxamine)
ইত্যাদি।
হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপনঃ হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন বা স্টেম সেল
ট্রান্সপ্লান্টেশন থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের জন্য একটি স্থায়ী চিকিৎসা হতে
পারে, তবে এটি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিদের জন্য যারা উপযুক্ত ডোনর পান। এই
প্রক্রিয়াতে, রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত হাড়ের মজ্জা (যেটি হিমোগ্লোবিন তৈরিতে অক্ষম)
পরিবর্তন করা হয়। এটি স্থায়ী নিরাময় দিতে পারে, তবে এটি একটি জটিল ও ব্যয়বহুল
প্রক্রিয়া, এবং ডোনরের উপস্থিতি এবং শরীরের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা
করতে হয়।
জেনেটিক পরামর্শ এবং বংশগত স্ক্রীনিংঃ যেহেতু থ্যালাসেমিয়া একটি
বংশগত রোগ, তাই জেনেটিক পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা থ্যালাসেমিয়া
মাইনর বা ক্যারিয়ার, তাদের জন্য গর্ভাবস্থায় স্ক্রীনিং করা যেতে পারে। বংশগত
স্ক্রীনিং এর মাধ্যমে জানা যায় যে, যে ব্যক্তির থ্যালাসেমিয়া মাইনর আছে, তার
সন্তান থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু। এই ধরনের স্ক্রীনিংয়ের মাধ্যমে
পরিবারের সদস্যদের থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে এবং পরবর্তী
প্রজন্মে রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।
কিছু খাদ্য পরামর্শ এবং আয়রন নিয়ন্ত্রণঃ যেহেতু থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের আয়রনের অতিরিক্ত পরিমাণ শরীরে জমে যেতে পারে, তাদের বিশেষভাবে আয়রন
গ্রহণের পরিমাণ সীমিত রাখা উচিত। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাকসবজি, মাংস, এবং
ডাল পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া উচিত। ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই এর পরিমাণ
বাড়ানো যায়, কারণ তারা শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন বের করতে সাহায্য করে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ক্যারিয়ার
ব্যক্তির জন্য, যারা সন্তান ধারণের পরিকল্পনা করছেন, তাদের গর্ভাবস্থায়
স্ক্রীনিং পরীক্ষা করানো উচিত। যদি বাবা-মা উভয়ই থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা
ক্যারিয়ার হন, তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে জেনেটিক পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এর মাধ্যমে তারা সঠিক তথ্য পেতে পারেন এবং পরবর্তী প্রজন্মে থ্যালাসেমিয়া
হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারেন।
পালসিট কেয়ারঃ কিছু ক্ষেত্রে, যদি থ্যালাসেমিয়া মেজরের রোগী
বয়সের কারণে বা চিকিৎসার ফলস্বরূপ শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, তবে পালসিট
কেয়ার (পালিয়েটিভ কেয়ার) প্রয়োগ করা যেতে পারে। পালসিট কেয়ার রোগীর শারীরিক
এবং মানসিক কষ্ট কমানোর জন্য সহায়ক চিকিৎসা প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে রোগীর
উপসর্গগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং তার জীবনযাত্রার মান উন্নত করা
যায়।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের যত্ন
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের যত্ন নেওয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং নিয়মিত
প্রক্রিয়া, যা বিশেষ চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক
জীবনযাপনে সহায়তা করতে পারে। থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল রোগ, তবে সঠিক চিকিৎসা
ও যত্নের মাধ্যমে শিশু একটি স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা হলো নিয়মিত রক্তসঞ্চালন।। নিচে
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের যত্নের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হলো।
আরও পড়ুনঃ আয়োডিনের অভাবে কি কি রোগ হয়
১. নিয়মিত রক্তসঞ্চালনঃ থ্যালাসেমিয়া মেজর আক্রান্ত রোগীদের
শরীর পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করতে পারে না, ফলে তাদের নিয়মিত
রক্তসঞ্চালন (Blood Transfusion) করতে হয়। এটি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা
বজায় রাখতে সহায়তা করে। থ্যালাসেমিয়ার কারণে লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত নষ্ট
হয়ে যায়, ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। এটি রক্তস্বল্পতা,
দুর্বলতা এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। তাই রোগীদের প্রতি ২-৪
সপ্তাহে একবার রক্তসঞ্চালন করানো প্রয়োজন হতে পারে।
২. আয়রন নিয়ন্ত্রণঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত
রক্তসঞ্চালন করতে হয়, ফলে তাদের শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমতে পারে। এই অতিরিক্ত
আয়রন হার্ট, লিভার, অগ্ন্যাশয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করতে
পারে। প্রতি ব্যাগ রক্তে প্রায় ২০০-২৫০ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। শরীর নিজে থেকে
সহজে অতিরিক্ত আয়রন অপসারণ করতে পারে না। অতিরিক্ত আয়রনযুক্ত খাবার খেলে
শরীরে আয়রনের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। এই অতিরিক্ত আয়রন অপসারণের জন্য Iron
Chelation Therapy প্রয়োজন হয়।
৩. পুষ্টিকর খাবার দেওয়াঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য
সঠিক পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস তাদের শক্তি বাড়াতে,
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করতে এবং শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
তবে, যেহেতু এই রোগীদের শরীরে আয়রন জমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, তাই খাবার
নির্বাচন করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত
রোগীদের জন্য যেসব খাবার উপকারী-ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ,
দই, মাছ), প্রোটিনযুক্ত খাবার (ডাল, ডিম, মুরগি, মাছ), ফল ও সবজি (টমেটো,
গাজর, শসা, আপেল, কমলা), ফোলিক অ্যাসিড (সবুজ শাকসবজি, বাদাম) তবে, আয়রনযুক্ত
খাবার কম খেতে হয়।
৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসাঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও যথাযথ চিকিৎসা
গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরে আয়রনের ভারসাম্য রক্ষা করা,
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং জটিলতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের জন্য প্রতি ২-৪ সপ্তাহে একবার রক্তসঞ্চালন করানো
প্রয়োজন। এটি শরীরের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এবং অক্সিজেন
সরবরাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
রক্তস্বল্পতা ও আয়রন অতিরিক্ততা থাকায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune
System) তুলনামূলক দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে তারা সহজেই সংক্রমণ, জ্বর,
ঠান্ডা, ফ্লু ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর
জীবনযাত্রা ও নিয়মিত চিকিৎসা অনুসরণ করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।
শিশুকে নিয়মিত টিকা দেওয়া (হেপাটাইটিস বি, নিউমোকক্কাল, ইনফ্লুয়েঞ্জা,
মেনিনজাইটিস ইত্যাদির টিকা), পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং সংক্রমণের
লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৬. মানসিক ও সামাজিক যত্নঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুরা শারীরিক
দুর্বলতার পাশাপাশি মানসিক চাপে ভুগতে পারে। এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা,
রক্তসঞ্চালন এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত
করতে পারে। রোগী এবং তার পরিবারকে শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক
সহায়তারও প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীকে সামাজিক জীবনে
অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া এবং তাকে সহানুভূতিশীল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা
গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় তারা সমাজে নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতা বা অসম্মান অনুভব
করতে পারেন, যা তাদের সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে। সুতরাং, তাদের সামাজিক
সহায়তা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৭. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি যত্নঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত
রোগীদের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত চিকিৎসা, সামাজিক সহায়তা, মানসিক সুস্থতা এবং শারীরিক যত্নের মাধ্যমে
তাদের একটি সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সুখী জীবনযাপন নিশ্চিত করা সম্ভব। রোগীর
নিয়মিত চিকিৎসা পর্যালোচনা, রক্তসঞ্চালন ও আয়রন নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য
প্রতি ৩-৪ সপ্তাহে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। সমাজে
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব তৈরি করা এবং তাদের
সম্পূর্ণরূপে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করা জরুরি। রোগী ও পরিবারের জন্য
পরিকল্পনা, সচেতনতা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সফল জীবনযাত্রা অর্জন
করা যায়।
থ্যালাসেমিয়া রোগীর খাবার তালিকা
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ
রোগের কারণে শরীরে আয়রনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শরীরের প্রয়োজনীয়
পুষ্টি উপাদানগুলো ঠিক রাখতে সঠিক খাবারের প্রয়োজন। কিছু খাবার শরীরে
অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, আবার কিছু খাবার শরীরের
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। নিচে
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সঠিক খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো।
১. আয়রন নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
শরীরে আয়রনের পরিমাণ বাড়তে পারে, বিশেষ করে যারা নিয়মিত রক্তসংযোজন করেন।
অতিরিক্ত আয়রন শরীরে জমা হয়ে যকৃত, হৃদপিণ্ড এবং অন্যান্য অঙ্গের জন্য
ক্ষতিকর হতে পারে। তাই আয়রন নিয়ন্ত্রিত খাবার বেছে নেয়া উচিত। এর মধ্যে
রয়েছে: লাল মাংস (গরু, খাসি এগুলো অত্যধিক পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়, তবে অল্প
পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে।
২. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারঃ ভিটামিন সি একটি গুরুত্বপূর্ণ
পুষ্টি উপাদান যা শরীরের নানা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে সহায়তা করে। এটি
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং আয়রন
শোষণে সাহায্য করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য ভিটামিন সি পরিমাণ যথাযথভাবে
নেওয়া উচিত, কারণ এটি আয়রন শোষণে সহায়তা করে এবং অতিরিক্ত আয়রন শরীর থেকে বের
করতে সাহায্য করতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে-সাইট্রাস ফল
কমলা, (লেবু, স্ট্রবেরি, কিভি) বেল পেপার (কাঁচা লাল বা সবুজ),টমেটো এবং
ব্রকলি।
৩. কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শক্তির জন্য
কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট খাবার গুরুত্বপূর্ণ।কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট হলো
এমন ধরনের শর্করা যা ধীরে ধীরে হজম হয়ে শরীরে শক্তি সরবরাহ করে এবং দীর্ঘসময়
ধরে এনার্জি প্রদান করে। এটি প্রধানত স্টার্চ এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারে পাওয়া
যায়, যা শরীরের জন্য উপকারী এবং সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কমপ্লেক্স
কার্বোহাইড্রেট সাধারণত প্রক্রিয়াজাত না হওয়া খাবারে বেশি থাকে এবং এটি শরীরে
এনার্জির জন্য দীর্ঘস্থায়ী উৎস হিসেবে কাজ করে। কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট
খাবার যেমন-গমের রুটি বা ব্রাউন রাইস (খুব বেশি শর্করা না রেখে), তালগাছের
গুড় বা মধু (সামান্য পরিমাণে), বাদাম, শস্যজাতীয় খাবার।
৪. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে যথাযথ
পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন একটি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, যা শরীরের কোষের গঠন, মেরামত এবং বিকাশে সহায়ক।
এটি হরমোন, এনজাইম এবং ইমিউন সিস্টেমের জন্য অপরিহার্য এবং শারীরিক শক্তি
বজায় রাখতে সহায়ক। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার শরীরের জন্য শক্তি সরবরাহ করে,
পেশী বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। প্রোটিন
সমৃদ্ধ খাবার-ডিম, মাছ, দুধ এবং পনির, সয়া এবং মাছের তেল (এগুলি সাধারণত ভালো
প্রোটিনের উৎস), ডাল (মুগ, সাদা মুগ, মসুর ডাল) ইত্যাদি।
৫. আয়রন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক খাবারঃ আয়রন শরীরের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। আয়রনের অভাবে
অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) হতে পারে, যা শরীরের শক্তি হ্রাস করে এবং ক্লান্তি
সৃষ্টি করতে পারে। আয়রনের নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট খাবার
রয়েছে, যেগুলি শরীরে আয়রন শোষণে সাহায্য করে অথবা অতিরিক্ত আয়রন থেকে রক্ষা
করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আয়রনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক কিছু খাবার
রয়েছে, যেগুলো আয়রন শোষণ কমাতে সাহায্য করে। আয়রন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক খাবার
গুলোর মধ্যে রয়েছে- মাশরুম, টমেটো, ভালশাক, কমলা (এগুলি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ,
যা আয়রন শোষণ কমাতে সহায়তা করে), গাজর, কুমড়ো, লাউ, শশা, বাঁধাকপি (ফাইবার
সমৃদ্ধ খাবার যা হজমে সাহায্য করে) ইত্যাদি।
৬. পুষ্টি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরের
সুস্থতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন
ভিটামিন এবং খনিজসমূহের সমন্বয় থাকা উচিত। পুষ্টি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার
আমাদের শরীরের শক্তি, বৃদ্ধি, এবং সঠিক কাজকর্ম বজায় রাখতে অপরিহার্য।
প্রতিটি ভিটামিন এবং পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালাতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীর
সুস্থ থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। পুষ্টি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ
খাবার যেমন- বেল পেপার, ব্রকলি, স্ট্রবেরি, পেঁপে, ফল ও শাকসবজি- যেমন মিষ্টি
আলু, গাজর, বাঁধাকপি ইত্যাদি।
৭. তরল খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরের আর্দ্রতা বজায় রাখা
এবং অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধে তরল খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিমাণ
পানি পান করা উচিত এবং বিশেষ করে ফল ও শাকসবজি থেকে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস
পাওয়া যেতে পারে। তরল খাবার আমাদের শরীরের সঠিক হাইড্রেশন বজায় রাখতে
সাহায্য করে এবং খাদ্য হজমেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তরল খাবার শুধু পানি
নয়, এর মধ্যে নানা ধরনের সুপ, জুস, স্মুদি, এবং অন্যান্য তরল খাবারও আসে।
এগুলি শরীরকে পুষ্টি প্রদান করে এবং শরীরের কোষগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করতে
সহায়তা করে।
থ্যালাসেমিয়া রোগী যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলি আয়রনের পরিমাণ
বেশি থাকার কারণে তাদের এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ অতিরিক্ত আয়রন শরীরে জমা হতে
পারে এবং তা বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া, কিছু খাবার রয়েছে যা
তাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে না বা চিকিৎসার সাথে
অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। নিচে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য এড়িয়ে
চলা খাবারের তালিকা দেওয়া হলো।
১. অধিক আয়রনযুক্ত খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের রক্তে
অতিরিক্ত আয়রন জমে যেতে পারে, কারণ তারা হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সক্ষম নয় এবং
রক্ত দেওয়ার ফলে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত আয়রন অঙ্গের ক্ষতি
করতে পারে, বিশেষত লিভার, হৃদযন্ত্র, এবং কিডনির জন্য। সুতরাং, এই রোগীদের
জন্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। লিভার, মাংস (বিশেষত গরুর
মাংস), শসা, পালং শাক, ডাল, তিল, খেজুর, রেড মিট, এবং আয়রন সমৃদ্ধ সেরোল বা
সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলা উচিত।
২. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারঃ ভিটামিন সি আয়রনের শোষণ বাড়িয়ে দেয়।
এটি বিশেষভাবে উপকারী যখন কেউ আয়রনসদৃশ খাবার খায়। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের জন্য অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহণ আরও আয়রন শোষণ করতে পারে, যা
অতিরিক্ত আয়রনের কারণে শরীরের ক্ষতি করতে পারে। লেবু, কমলা, আমলকি,
স্ট্রবেরি, পেঁপে, টমেটো, কলা, ব্রকলি, ব্রাসেল স্প্রাউট, লাল মরিচ এবং
অন্যান্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত।
৪. ফাস্ট ফুড এবং প্রসেসড খাবারঃ ফাস্ট ফুড এবং প্রসেসড খাবারে
বেশি মাত্রায় ফ্যাট, লবণ, চিনি, এবং কৃত্রিম উপাদান থাকে, যা স্বাস্থ্যহানিকর
হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল
থাকে, তাই এসব খাবার খেলে আরো নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ফাস্ট ফুড (ফ্রায়েড খাবার, পিজ্জা, বার্গার), কেক, পেস্ট্রি, কুকিজ, চিপস,
ইনস্ট্যান্ট নুডলস, ফুড কনসারভেটিভস সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ।
৫. অতিরিক্ত দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীরা
ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করতে হয়। অতিরিক্ত দুধ এবং
দুগ্ধজাত পণ্য বেশি ক্যালসিয়াম শোষণ এবং রক্তের আয়রন স্তরের উপর প্রভাব ফেলতে
পারে। বিশেষ করে যাদের অতিরিক্ত আয়রন জমে গেছে, তাদের দুধের পরিমাণ
নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাই অতিরিক্ত দুধ, দই, মাখন, পনির এবং অন্য দুগ্ধজাত
পণ্য এড়িয়ে চলা উচিত।
৬. বিশেষ কিছু ধরণের সাপ্লিমেন্টসঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আয়রন
সাপ্লিমেন্ট না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এতে শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমে
যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সাপ্লিমেন্টস গ্রহণের ক্ষেত্রে
খুব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বিশেষ করে আয়রন এবং ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট
পরিহার করা উচিত, কারণ এগুলি শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে
পারে। তবে অন্যান্য সাপ্লিমেন্টস যেমন ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম
ইত্যাদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করা যেতে পারে।
৭. অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবারঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত
রোগীদের জন্য অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি
করতে পারে। যেহেতু থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল রক্তের রোগ, যেখানে রক্তের
হিমোগ্লোবিন তৈরি হতে পারে না বা অস্বাভাবিক থাকে, অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত
খাবার খাওয়ার কারণে তাদের শরীরের কিছু প্রতিকূল প্রভাব হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল সমস্যা যেমন পেটে গ্যাস,
কোষ্ঠকাঠিন্য, এলাৰ্জি, কোলেস্টেরল, হৃদরোগের ঝুঁকি এবং অম্বল হতে পারে।
অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবার এসব সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। সেজন্য
তেলেভাজা খাবার, অতিরিক্ত মশলাদার বা ঝাল খাবার, বিরিয়ানি, তেলপোড়া খাবার
ইত্যাদি এড়িয়ে চলবেন।
৮. কফি ও চাঃ কফি ও চায়ের মধ্যে ক্যাফেইন থাকে, যা শরীরের আয়রন
শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরে আয়রনের
অতিরিক্ত উপস্থিতি থাকে, তাই ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন কফি ও চা খাওয়ার ফলে
শরীরে আরও বেশি আয়রন শোষণ হতে পারে এবং অতিরিক্ত আয়রন জমে যেতে পারে।
অতিরিক্ত আয়রন শরীরে নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন লিভার, কিডনি বা
হৃদরোগ। ক্যাফেইন শরীর থেকে আয়রন শোষণ কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এটি অতিরিক্ত
আয়রন জমার ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যা থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বিপজ্জনক।
শেষকথাঃ থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
থ্যালাসেমিয়া দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল রোগ হলেও, সঠিক চিকিৎসা এবং যত্নে রোগীর
জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর অথচ
প্রতিরোধযোগ্য রক্তের রোগ। এটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা কঠিন হলেও, আধুনিক
চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। নিয়মিত চিকিৎসা, সঠিক
পুষ্টি গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা দীর্ঘ ও
স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
তবে, এই রোগের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিকার হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
যেহেতু এটি জিনগত রোগ, তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়ার হাত থেকে রক্ষা
করতে বিবাহের আগে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। যদি দুজনই
থ্যালাসেমিয়া বাহক হন, তবে পরবর্তী প্রজন্মে থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার
ঝুঁকি থাকে, যা জীবনব্যাপী কষ্টের কারণ হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি
করা এবং পরিবার পরিকল্পনার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
থ্যালাসেমিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে
সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, জিনগত পরামর্শ এবং আধুনিক চিকিৎসা
পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা এই রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনতে পারি। একটি সুস্থ সমাজ
গড়তে হলে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানা এবং তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া
আমাদের সবার দায়িত্ব। আশা করছি, থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url