গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়, বিষয়টি অনেকেই জানেন না।
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি
বৃদ্ধি পায়। এই কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। হিমোগ্লোবিন
হলো রক্তের প্রধান উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি
মা ও শিশুর সুস্থতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সাধারণত, একজন গর্ভবতী মায়ের
হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১১-১৪ গ্রাম/ডেসিলিটার (g/dL) হওয়া উচিত। তবে
কিছু ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব কমে গেলে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে
পারে।
- হিমোগ্লোবিন কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকার
- হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি সমস্যা হতে পারে
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার লক্ষণ
- গর্ভাবস্থায় কোন খাবার খেলে হিমোগ্লোবিন বাড়ে
- গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা দূর করার উপায়
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয়
- গর্ভবতীর রক্তসল্পতা থাকলে গর্ভের বাচ্চার কি হয়
- শেষকথাঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
হিমোগ্লোবিন কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
হিমোগ্লোবিন হলো এক ধরনের প্রোটিন, যা লোহিত রক্তকণিকায় থাকে এবং এটি শরীরে
অক্সিজেন পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি আয়রন এবং
প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত এবং রক্তকে লাল রঙ প্রদান করে। গর্ভাবস্থায় মায়ের
শরীরে রক্তের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, কারণ গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত
অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করা প্রয়োজন। যদি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব কমে
যায়, তবে মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকি বাড়তে পারে।
গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য হিমোগ্লোবিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। এটি লোহিত রক্তকণিকার একটি প্রোটিন যা শরীরে অক্সিজেন
পরিবহন করে এবং শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গর্ভকালীন সময়ে রক্তের পরিমাণ
প্রায় ৪০-৫০% বৃদ্ধি পায়, তাই পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন না থাকলে
রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে, যা মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
নিচে গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলোঃ
১. শিশুর পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করেঃ গর্ভাবস্থায় শিশুর
সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ভ্রূণ নিজে শ্বাস নিতে পারে না, তাই মায়ের রক্তের
মাধ্যমে শিশুর শরীরে অক্সিজেন পৌঁছায়। এই অক্সিজেন পরিবহনের মূল দায়িত্ব
হিমোগ্লোবিনের (Hb) ওপর নির্ভরশীল। হিমোগ্লোবিন হল এক ধরনের প্রোটিন যা
ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে এবং রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন কোষে
পৌঁছে দেয়।
গর্ভস্থ শিশুর অক্সিজেন সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে মায়ের রক্তের উপর নির্ভরশীল।
গর্ভাবস্থায় প্ল্যাসেন্টার (গর্ভনালির) মাধ্যমে মা থেকে শিশুর শরীরে
অক্সিজেন যায়। যদি মায়ের হিমোগ্লোবিন কম থাকে, তাহলে শিশুর পর্যাপ্ত
অক্সিজেন পেতে সমস্যা হয়, যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি
করতে পারে। গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসে শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র দ্রুত
বিকাশ লাভ করে। এই সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব হলে শিশুর নিউরাল টিউব
ডিফেক্ট বা ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা হতে পারে।
২. গর্ভকালীন জটিলতা প্রতিরোধ করেঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের সঠিক
মাত্রা মায়ের সুস্থতা ও শিশুর সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করে। যদি হিমোগ্লোবিনের
পরিমাণ কমে যায়, তাহলে মা ও শিশুর জন্য বিভিন্ন জটিলতা (complications)
তৈরি হতে পারে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকলে গর্ভবতী মায়ের ক্লান্তি,
মাথা ঘোরা, দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যাগুলো কম হয়। কম হিমোগ্লোবিন
থাকলে গর্ভাবস্থায় প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া এবং প্ল্যাসেন্টা সংক্রান্ত
জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে যদি হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে,
তাহলে এসব সমস্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৩. প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমায়ঃ প্রসবের সময় কিছু
পরিমাণ রক্তক্ষরণ স্বাভাবিক। কিন্তু যদি প্রসবকালীন সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
হয় মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে। প্রসবের সময় বা প্রসবের পর
৫০০ মিলিলিটার বা তার বেশি রক্তক্ষরণ হলে তাকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বলা হয়।
এটি মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে শরীরে আয়রনের
সরবরাহ নিশ্চিত হয়, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।হিমোগ্লোবিন কম থাকলে
রক্ত সহজে বন্ধ হয় না এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৪. গর্ভস্থ শিশুর ওজন কম হওয়া প্রতিরোধ করেঃ হিমোগ্লোবিন কম থাকলে
শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছায় না, ফলে শিশুর জন্মের সময়
ওজন কম হতে পারে। হিমোগ্লোবিনের সঠিক মাত্রা গর্ভস্থ শিশুর ওজন স্বাভাবিক
রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন কোনো শিশুর জন্মের সময় ওজন ২.৫
কেজির নিচে থাকে, তাকে কম ওজনের শিশু বলা হয়। কম ওজনের শিশুর রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা কম থাকে এবং পরবর্তীতে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা
দিতে পারে।
৫. প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির ঝুঁকি কমায়ঃ হিমোগ্লোবিনের সঠিক
মাত্রা গর্ভাবস্থায় প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। হিমোগ্লোবিন কম থাকলে প্রি-টার্ম বার্থ বা নির্ধারিত
সময়ের আগে (৩৭ সপ্তাহের আগে) শিশুর জন্মের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
প্রিম্যাচিউর শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি
সৃষ্টি হতে পারে, এবং এর জন্য অতিরিক্ত যত্ন ও চিকিৎসা প্রয়োজন। অপরিপক্ব
শিশুদের শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং মস্তিষ্কের জটিলতার ঝুঁকি বেশি থাকে।
৬. মা ও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
হচ্ছে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং
অন্যান্য রোগজীবাণু থেকে আমাদের রক্ষা করে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরকে
নানা রোগ থেকে রক্ষা করতে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় থাকে। গর্ভের শিশুর ইমিউন
সিস্টেম অনেকটা মায়ের সুরক্ষার ওপর নির্ভরশীল, কারণ শিশুর নিজস্ব রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতে কিছু সময় নেয়।গর্ভাবস্থায় আয়রন ও
হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে তিনি
সহজেই সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয় এ সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন
না। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের প্রধান উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন
সরবরাহ করে। গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, ফলে অনেক সময়
হিমোগ্লোবিন কিছুটা কমে যায়। তবে যদি হিমোগ্লোবিন মাত্রাতিরিক্ত কমে যায়,
তাহলে মা ও শিশুর জন্য গুরুতর জটিলতা তৈরি হতে পারে, যার জন্য রক্ত দেওয়া
প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হবার যথেষ্ট কারণ থাকে, গর্ভবতী নারীর ক্যালরির
সঙ্গে লৌহ বা আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং চাহিদা মতো লৌহ পূরণ না হলে
এই সময় রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে,
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন লেভেল যদি ৭ g/dL-এর নিচে নেমে
যায়, তবে এটি গুরুতর রক্তস্বল্পতা হিসেবে ধরা হয় এবং রক্ত দেওয়া লাগতে
পারে, বিশেষ করে যদি মা দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বা হৃদযন্ত্রের
জটিলতা অনুভব করেন।
গর্ভাবস্থায় রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা,
শারীরিক লক্ষণ এবং অন্যান্য ঝুঁকির উপর। গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা
যদি ৭ g/dL বা তার কম হয়, তাহলে তা মারাত্মক রক্তস্বল্পতা হিসেবে বিবেচিত
হয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে
হিমোগ্লোবিন সামান্য কম হলে প্রথমে খাদ্য, সাপ্লিমেন্ট এবং ইনজেকশন দিয়ে
বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। আশা করছি, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত
দিতে হয় এ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকার
গর্ভাবস্থায় শরীরে রক্তের পরিমাণ ৪০-৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, কারণ
গর্ভস্থ শিশুকে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহের জন্য মায়ের শরীরে অতিরিক্ত
রক্ত উৎপাদন প্রয়োজন। এই সময় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কিছুটা কমতে পারে,
তবে একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে গেলে মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকি তৈরি
হয়। এই কারণে হিমোগ্লোবিনের (Hb) মাত্রা বজায় রাখা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি অক্সিজেন পরিবহনের জন্য দায়ী একটি প্রোটিন যা
লোহিত রক্তকণিকায় থাকে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সাধারণত ১১-১৪ গ্রাম/ডেসিলিটার (g/dL)
হওয়া স্বাভাবিক ধরা হয়। তবে যদি এটি ৭ g/dL বা তার কম হয়, তাহলে তা
মারাত্মক রক্তস্বল্পতা হিসেবে বিবেচিত হয়। ৯-১০.৯ g/dL হলো মৃদু
রক্তস্বল্পতা ধরা হয়, এক্ষেত্রে সাধারণত খাবার ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে
সামলানো যায়। ৭-৮.৯ g/dLহলো মাঝারি রক্তস্বল্পতা এবং ৭ g/dL-এর কম হলে
গুরুতর রক্তস্বল্পতা, যেখানে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
ত্রৈমাসিকভেদে গর্ভবতী মায়ের হিমোগ্লোবিনের আদর্শ মাত্রাঃ
ত্রৈমাসিক | হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা |
---|---|
প্রথম ত্রৈমাসিক (১-৩ মাস) | ১১ g/dL বা তার বেশি |
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (৪-৬ মাস) | ১০.৫ g/dL বা তার বেশি |
তৃতীয় ত্রৈমাসিক (৭-৯ মাস) | ১১ g/dL বা তার বেশি |
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১১-১৪ গ্রাম/ডেসিলিটার
(g/dL) হওয়া উচিত। গর্ভাবস্থায় যদি হিমোগ্লোবিন ১০ g/dL-এর নিচে নেমে
যায়, তাহলে মায়ের রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) আছে বলে ধরা হয়। ৭ g/dL
বা তার কম হলে গুরুতর রক্তস্বল্পতা ধরা হয় এবং রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হতে
পারে।
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি সমস্যা হতে পারে
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। হিমোগ্লোবিন শরীরে
অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি হিমোগ্লোবিনের
পরিমাণ কমে যায়, তাহলে অক্সিজেন সঠিকভাবে শরীরের কোষে পৌঁছাতে পারে না,
এবং এর ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন ক্লান্তি,
শ্বাসকষ্ট, হার্টের ওপর চাপ, এবং গর্ভাবস্থায় নানা জটিলতা। তাই
হিমোগ্লোবিনের সঠিক মাত্রা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিমোগ্লোবিন
কমে গেলে যেসব সমস্যা হতে পারেঃ
১. অ্যানিমিয়াঃ অ্যানিমিয়া হলো একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে, ফলে রক্ত শরীরের কোষে যথেষ্ট
পরিমাণে অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে না। গর্ভাবস্থায় যদি মা
হিমোগ্লোবিনের অভাবে আক্রান্ত হন, তাহলে এটি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য
এবং বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন কম ওজন, প্রিম্যাচিউর জন্ম, বা
শ্বাসকষ্ট, শক্তির অভাব এবং শরীরের কার্যক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ
অক্সিজেনের ঘাটতি শরীরের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
২. ক্লান্তি এবং দুর্বলতাঃ হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরের কোষে
অক্সিজেন পৌঁছাতে সমস্যা হয়, যার ফলে বিভিন্ন শারীরিক কার্যক্রম
সঠিকভাবে চলতে পারে না। এই কারণে আপনার শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়বে
এবং শক্তিহীন অনুভূতি হতে পারে। সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মে যেমন হাঁটা,
রান্না করা, বা অন্য কোনো কাজ করার সময় অনেক সময় ক্লান্তি অনুভূত হতে
পারে। দীর্ঘসময় বসে থাকলে কিংবা কাজ করার সময় আরও বেশি ক্লান্তি এবং
শক্তিহীনতা অনুভূত হতে পারে।
৩. শ্বাসকষ্টঃ রক্তে হিমোগ্লোবিনের অভাবে শরীরে অক্সিজেনের
ঘাটতি হয়, ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তে থাকা একটি
গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, যা অক্সিজেন পরিবহন করে শরীরের কোষে। যখন
হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়, তখন রক্তের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা কমে
যায়, যার ফলে শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে। এটি বিশেষভাবে
দেখা যায় শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা কঠোর কাজ করার পর। আপনি যদি হাঁটতে
বা দৌড়াতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন, তবে এটি হিমোগ্লোবিন কম থাকার
একটি লক্ষণ হতে পারে।
৪. হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ বৃদ্ধিঃ হিমোগ্লোবিন একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রোটিন যা রক্তের লাল কণিকাতে থাকে এবং এটি শরীরের প্রতিটি কোষে
অক্সিজেন পরিবহন করে। হিমোগ্লোবিন কম হলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে
যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও কোষে অক্সিজেন পৌঁছানোর পরিমাণ কমে যায়।
অক্সিজেনের অভাবে শরীরের কার্যক্রম সচল রাখতে অঙ্গগুলোকে অতিরিক্ত
পরিশ্রম করতে হয়, যার ফলে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ বাড়ে। এটি হৃদরোগ,
স্ট্রোক, বা হৃদরোগের অচল অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে।
৫. মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, এবং অবশতাঃ হিমোগ্লোবিন রক্তের
মাধ্যমে অক্সিজেন পরিবহন করে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন
পৌঁছাতে সমস্যা হয়, যা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে
পারে। হিমোগ্লোবিন কম হলে রক্তে অক্সিজেন কম থাকে, এবং রক্ত
সঞ্চালনের সময়ও ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যখন
হিমোগ্লোবিন কম থাকে, তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে মস্তিষ্ক এবং
স্নায়ু সিস্টেমে অক্সিজেনের অভাব হয়। এর ফলে মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা এবং
অবশতা হতে পারে।
৬. রক্তচাপ কমে যাওয়াঃ হিমোগ্লোবিন রক্তের মাধ্যমে শরীরের
প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে রক্তে
অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়, যার ফলে হৃৎপিণ্ড ও অন্যান্য অঙ্গগুলোর
কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে রক্তচাপ হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে শরীরের বিভিন্ন
অংশে অক্সিজেন ও পুষ্টির সঠিক সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। রক্তচাপ কমলে
আপনি সাধারণত দূর্বল অনুভব করবেন এবং আপনার দৃষ্টি অস্পষ্ট হতে পারে।
নির্দিষ্ট অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে (যেমন দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকা), আপনার
মাথা ঘুরতে বা মাথা ঝিমঝিম করার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৭. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়াঃ হিমোগ্লোবিন কম
হলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি শরীরকে সহজেই
সংক্রমণ, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগের প্রতি সংবেদনশীল করে
তোলে। শ্বেত রক্তকণিকা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূল অংশ। যখন
হিমোগ্লোবিন কমে যায়, তখন শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা কমে গিয়ে
সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কম হলে এটি মা এবং
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে, যা বিশেষভাবে সংক্রামক রোগে
আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
৮. গর্ভাবস্থায় সমস্যাঃ গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত
হিমোগ্লোবিন থাকা জরুরি। কারণ এটি শরীরের কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন
সরবরাহ করে, যা মায়ের স্বাস্থ্য ও শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য
অপরিহার্য। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে (অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা) মা ও
শিশুর জন্য বেশ কিছু গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে। শিশুর সঠিক বিকাশে
বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন কম ওজন বা প্রিম্যাচিউর জন্ম।গর্ভস্থ
শিশুর শ্বাসযন্ত্র বা অন্যান্য অঙ্গের বিকাশে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মায়ের সুস্থতা নিয়েও সমস্যা হতে পারে, যেমন প্রসবকালীন অতিরিক্ত
রক্তক্ষরণ বা গর্ভধারণের জটিলতা।
৯. ত্বকের রঙ ফ্যাকাশে হওয়াঃ হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ত্বকের
স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে ফ্যাকাশে দেখাতে পারে। হিমোগ্লোবিন
রক্তের প্রধান উপাদান যা অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। যখন শরীরে
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায় (অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা), তখন
শরীরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে ত্বকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি
পৌঁছাতে পারে না। ফলে ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে ফ্যাকাশে বা
বিবর্ণ দেখাতে পারে। এটি এড়াতে আয়রন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া,
পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
১০. মেমোরি বা স্মৃতিশক্তি দুর্বলতাঃ পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন না
থাকলে মস্তিষ্কের নিউরনের (স্নায়ুকোষ) কার্যকারিতা কমে যায়, যার ফলে
মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে। হিমোগ্লোবিন মস্তিষ্কের
কার্যকারিতা ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায় (অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা), তখন
মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এর ফলে স্মৃতিশক্তি
দুর্বল হওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং মানসিক ক্লান্তির মতো সমস্যা দেখা
দিতে পারে। সঠিক পুষ্টি, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং
মানসিক সচেতনতা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার মূল কারণ হলো আয়রন, ফলিক অ্যাসিড
ও ভিটামিন B12-এর ঘাটতি। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রক্তের
পরিমাণ প্রায় ৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, ফলে লোহিত রক্তকণিকার জন্য
বেশি পরিমাণ হিমোগ্লোবিন প্রয়োজন হয়। যদি এই চাহিদা পূরণ না হয়,
তাহলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে
পারে। গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলো আলোচনা করা
হলো।
১. আয়রনের অভাবঃ আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যা হিমোগ্লোবিন
তৈরিতে সহায়তা করে। হিমোগ্লোবিন মূলত আয়রনসমৃদ্ধ প্রোটিন, যা অক্সিজেন
বহন করার কাজ করে। গর্ভাবস্থায় শরীরে বেশি রক্ত তৈরি হয়, ফলে আয়রনের
চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যদি মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত আয়রন না থাকে,
তবে হিমোগ্লোবিন তৈরি কমে যায় এবং আয়রন-ঘাটতি দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ ৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ফলে
শরীরের আয়রনের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যদি মা পর্যাপ্ত আয়রন গ্রহণ
না করেন, তাহলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায় এবং রক্তস্বল্পতা দেখা
দেয়।
২. ফলিক অ্যাসিডের অভাবঃ ফলিক অ্যাসিড শরীরের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য। ফলিক অ্যাসিড (Vitamin
B9) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন, যা শরীরে নতুন কোষ তৈরি এবং লোহিত
রক্তকণিকা (Red Blood Cells) গঠনে সাহায্য করে। এটি গর্ভাবস্থায় খুবই
গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের গঠন ঠিক রাখতে
সাহায্য করে এবং নিউরাল টিউব ডিফেক্ট প্রতিরোধ করে। এর অভাবে
রক্তস্বল্পতা, ক্লান্তি, স্মৃতিশক্তি দুর্বলতা ও গর্ভকালীন জটিলতা দেখা
দিতে পারে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে ফলিক
অ্যাসিডের অভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৩. ভিটামিন B12-এর অভাবঃ ভিটামিন B12 (Cobalamin) একটি
গুরুত্বপূর্ণ জলবিদারী ভিটামিন, যা রক্তকণিকা তৈরিতে,
স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতায় এবং DNA সংশ্লেষণে ভূমিকা রাখে। এটি
হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক, ফলে শরীরের অক্সিজেন পরিবহন প্রক্রিয়া
সচল রাখে। ভিটামিন B12-এর অভাবে রক্তকণিকা সঠিকভাবে তৈরি হতে পারে
না, ফলে পার্নিসিয়াস অ্যানিমিয়া (Pernicious Anemia) হতে পারে।
যেসব মায়েরা মাছ, ডিম বা দুগ্ধজাত খাবার কম খান, তাদের এই সমস্যা
হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।ভিটামিন B12-এর অভাবে রক্তস্বল্পতা,
ক্লান্তি, স্নায়বিক সমস্যা এবং মানসিক অবসাদও দেখা দিতে পারে।
৪. জেনেটিক বা বংশগত রোগঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে
যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কারণ হলো জেনেটিক বা বংশগত রোগ।
এগুলো এমন কিছু রোগ যা পরিবারে পূর্বে কারো থাকলে সন্তানদের মধ্যেও
দেখা দিতে পারে। এসব রোগ রক্তের গঠন বা রক্তকণিকার কার্যকারিতা
ব্যাহত করে, ফলে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা সম্ভব
হয় না। সময়মতো স্ক্রিনিং, সচেতনতা এবং চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মা ও
শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব। জেনেটিক স্ক্রিনিং আপনাকে ভবিষ্যতের
অনেক জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এটি শুধু একটি পরীক্ষা নয়, বরং
এটি একটি সচেতন সিদ্ধান্ত, মা-বাবা হিসেবে সুস্থ সন্তানের জন্য।
৫. রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি ও রক্তের স্বাভাবিক হ্রাসঃ রক্তসঞ্চালন
শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা অক্সিজেন, পুষ্টি উপাদান
ও হরমোন শরীরের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণ
করতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহিত হয়,
ফলে রক্তের তরল অংশের পরিমাণ বেশি হয়ে যায় এবং লোহিত রক্তকণিকার
ঘনত্ব কমে যায়। এটি ডাইলিউশনাল অ্যানিমিয়া নামে পরিচিত, যা
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে বেশি দেখা যায়।
গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ ৩০-৫০% বৃদ্ধি পায়, যা গর্ভস্থ শিশুর
বৃদ্ধি ও মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সহায়ক। তবে রক্তসঞ্চালন
বাধাগ্রস্ত হলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৬. গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধিঃ গর্ভাবস্থায় গর্ভস্থ সন্তানের
বৃদ্ধি শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনতে পারে। এই সময় শরীরের
অনেক রক্ত, পুষ্টি ও অক্সিজেন সন্তানের জন্য ব্যবহৃত হয়, ফলে মায়ের
শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব কমে যেতে পারে। গর্ভের তৃতীয়
ট্রাইমেস্টারে, সন্তানের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং এতে অতিরিক্ত পুষ্টি ও
অক্সিজেনের চাহিদা সৃষ্টি হয়, যা মায়ের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ
কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৭. রক্তক্ষরণ বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাতঃ গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ
বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাত একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে, যা মা ও শিশুর
জন্য বিপদজনক হতে পারে। এর কিছু কারণ রয়েছে, যা গর্ভাবস্থার বিভিন্ন
পর্যায়ে ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থায় হেমোরয়েডস (পাইলস), গ্যাস্ট্রিক
আলসার বা অতিরিক্ত মাসিক রক্তপাত থাকলে আয়রন ও লোহিত রক্তকণিকার অভাব
দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় যেকোনো রক্তক্ষরণ উপেক্ষা করা উচিত
নয়, যদি তা সামান্য হয়। কারণ এটি হতে পারে কোনো বড় জটিলতার
পূর্বাভাস।
৮. একাধিক গর্ভধারণঃ গর্ভাবস্থায় একবার রক্তশূন্যতা হলে সেটা
অনেক যত্নের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু যদি একজন নারী পর্যাপ্ত
সময়ের ব্যবধান না রেখে একাধিকবার গর্ভধারণ করেন, তাহলে তার শরীর
পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার (recovery) করার সুযোগ পায় না। এর ফলে
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া বা ক্রনিক অ্যানিমিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে
যায়। প্রতিটি গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে শিশুর প্রয়োজনীয় আয়রন,
ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি সরবরাহ হয়।
৯. অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসঃ গর্ভাবস্থায় একজন
নারীর শরীরের পুষ্টির চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে
যায়। এই সময়ে যদি মা অপুষ্টিতে ভোগেন বা খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস
সঠিক না হয়, তাহলে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা মা ও
অনাগত শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। গর্ভাবস্থায়
অপুষ্টি বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হিমোগ্লোবিন কমিয়ে মায়ের
ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, রক্তস্বল্পতা এবং শিশুর কম ওজনসহ নানা জটিলতা
তৈরি করতে পারে। আয়রন, ভিটামিন B12, ফলিক অ্যাসিড, প্রোটিন, ভিটামিন C এসব পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত না খান, তাহলে শরীরে
পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা (RBC) তৈরি হতে পারে না, ফলে হিমোগ্লোবিন
কমে যায়।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার ফলে গর্ভবতী মায়ের নানা
রকমের শরীরে জটিলতা সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতা কমে যাওয়ার কারণে
রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭ এর কম হলে মা ও গর্ভে শিশুর বিভিন্ন জটিলতা
দেখা দিতে পারে এর মধ্যে রয়েছে প্রি-একলাম্পসিয়া, কার্ডিয়া ফেইিউর, রোগ
সংক্রমণ ও প্রসাপ পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। সংক্ষেপে গর্ভাবস্থায়
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার লক্ষনগুলো বর্ণনা করা হলোঃ
- ঘন ঘন ক্লান্তি অনুভব ও মাথা ঘোরা
- শরীরে দুর্বলতা দেখা দেয় বা অবসাদ
- শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হওয়া
- দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদ স্পন্দন
- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বা অবশ লাগা
- মনোযোগের অভাব ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া
- ঠোঁটের কোণে ক্ষত, জিহ্বায় ঘা।
- মুখ ফ্যাকাসে হওয়া ও চোখ সাদা হয়ে যাওয়া
- পা ফুলে যেতে পারে ওবুক ধরফর করে।
- চুল পড়া ও নখ ভঙ্গুর হওয়া
গুরুত্ব এই লক্ষণ গুলো প্রাথমিকভাবে হালকা হতে পারে তবে এগুলো উপেক্ষা করলে
পরবর্তী সময়ে ঝুকের কারণ হয়ে যায় সাথে সাথে লক্ষণগুলো দেখা দিলে খারাপ
দিকে যেতে পারে এই জন্য লক্ষণের উপসর্গ কোনটা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে
যেতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় কোন খাবার খেলে হিমোগ্লোবিন বাড়ে
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য কিছু খাবার খুবই উপকারী। হিমোগ্লোবিন
হলো রক্তে অক্সিজেন পরিবহণকারী প্রোটিন, এবং এটি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য
আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত আয়রন, ভিটামিন B12, ফোলেট এবং ভিটামিন C থাকতে হবে।
আমাদের আশেপাশে বেশ কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো সঠিক পরিমাণে খেলে আমাদের শরীরে
কখনোই হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি দেখা দিবে না। নিচে কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া
হলো, যা গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করবে।
প্রাণীজ জাতীয় খাদ্যঃ প্রাণীজ খাদ্য গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি
শক্তিশালী পুষ্টির উৎস, যা হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি, শারীরিক শক্তি এবং গর্ভস্থ
শিশুর বিকাশে সহায়ক। প্রাণীজ জাতীয় খাদ্য এমন খাবার, যা প্রাণী থেকে পাওয়া
যায়। এই ধরনের খাবারে সাধারণত প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন B12, এবং অন্যান্য
পুষ্টিগুণ থাকে, যা শরীরের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায়, এসব খাদ্য হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি এবং শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণে
সহায়ক। যেমনঃ কলিজা, দুধ, ডিম, মাংস ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় এই সকল খাবার
খেলে শরীরে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ বৃদ্ধি হবে এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দেবে না।
সামুদ্রিক মাছঃ সামুদ্রিক মাছ গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর
এবং এটি হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
কার্যক্রমে সহায়ক। সামুদ্রিক মাছ বা মেরিন ফিশ হলো সেই মাছ যা সমুদ্র থেকে
আহৃত হয়। এগুলো প্রোটিন, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন D এবং B12
সমৃদ্ধ। গর্ভাবস্থায় এগুলি খাওয়া অনেক উপকারী, কারণ এগুলো হিমোগ্লোবিন
বৃদ্ধি, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো এবং মস্তিষ্কের উন্নয়নে সাহায্য করে। তাই
গর্ভাবস্থায় যদি কোন মহিলা সামুদ্রিক মাছ খায় তাহলে তার রক্তস্বল্পতার
সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। তবে মাছ খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত,
বিশেষত Mercury বা পারদযুক্ত মাছ এড়ানো উচিত।
শাক সবজি ও ফলমূলঃ শাক সবজি ও ফলমূল গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। গর্ভাবস্থায় শাকসবজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
কারণ এগুলো প্রচুর পরিমাণে ফোলেট (ফলিক অ্যাসিড), আয়রন, ভিটামিন C, ভিটামিন
A এবং ম্যাগনেসিয়াম সরবরাহ করে। এগুলো রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) দূর করতে
এবং গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ু ব্যবস্থা, কোষ এবং মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক।
গর্ভাবস্থায় ফলমূল খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো ভিটামিন, খনিজ,
ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পানি সরবরাহ করে, যা মা এবং শিশুর
স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এসব খাবার গর্ভবতী মায়েদের জন্য
হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি, শক্তি সঞ্চালন, হজমে সহায়ক এবং গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে
সাহায্য করে।
গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা দূর করার উপায়
গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা দূর করতে হলে প্রথমে এর কারণ বুঝে, তারপর সঠিক
পুষ্টি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হয়। গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে
মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। একজন নারী যখন গর্ভবতী
হয় তখন তার নানা রকমের সমস্যা হয় এর মধ্যে অন্যতম হলো রক্তশূন্যতা। এটি
বিশ্বব্যাপী সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা এজন্য স্বল্প উন্নত দেশগুলোতে গর্ভকালীন
রক্তশূন্যতার জন্য ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয়ে থাকে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা দূর করতে হলে "খাদ্য + সাপ্লিমেন্ট + নিয়মিত
পর্যবেক্ষণ" – এই তিনটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো চিকিৎসা না করলে মা ও
শিশুর উভয়ের জন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন- কম ওজনের শিশু, প্রিম্যাচিউর
ডেলিভারি, প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। গর্ভধারণের আগে স্বাস্থ্য
পরীক্ষা করতে হবে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের শতকরা 10 গ্রামের কম থাকলে
চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এছাড়াও কলিজা, মাংস, ডিম, সবুজ শাক-সবজি, মাটরশুটি, কলা, পেয়ারা, আনারের
মতো আমি ভিটামিন ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে হবে। খাদ্যতালিকা আয়রন
যুক্ত খাবার নিয়মিত রাখতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আয়রন ট্যাবলেট
খেতে হবে। কোন সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে গর্ভকালীন সময় নিয়মিত
চেকআপ করতে হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি তিন মাস অন্তরের অন্তর একবার
করে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করতে হবে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয়
সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীদের রক্তে হিমোগ্লোবিন কম থাকে।আর গর্ভাবস্থায়
এই সমস্যাটি প্রকট হয়ে যায়।বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় শিশু সুস্থ ভাবে গর্ভে
বেড়ে উঠতে গর্ভবতী নারীকে রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।কারণ আমাদের
দেহের কোষ গুলোকে সক্রিয় এবং কর্মক্ষম রাখতে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা
স্বাভাবিক থাকা খুবই জরুরী।
রক্তে হিমোগ্লোবিনে মাত্রা কম হলে,কিছু সিমটম দেখা দিতে পারে।যেমন চেহারা
ফেকাসে আছে দেখায়,সারাক্ষণ ক্লান্তি লাগে,সামান্য পরিশ্রমে কষ্ট হয়।খাবারে
অরুচি থাকে। সবকিছুতেই মনোযোগের অভাব দেখা যায়।হজমে অসুবিধা হয়, বুক ধরফর
করে,জিব্বা মুখে ঘা হতে পারে ইত্যাদি।আবার কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত হয়ে
যেতে পারে।
১. আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণঃ হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য আয়রনসমৃদ্ধ
খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়। হিমোগ্লোবিন
উৎপাদনে লোহা বা আয়রনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আয়রন মূলত দুই প্রকারের হয়
যেমনঃ হিম আয়রন, এটি প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া যায় এবং শরীরে সহজে শোষিত
হয়। নন-হিম আয়রন, এটি মুলত উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে পাওয়া যায়, তবে শোষণ কম
কার্যকর।
এটি প্রাণিজ উৎস যেমন- গরুর মাংস, মুরগির কলিজা, ডিমের কুসুম, মাছ (বিশেষ করে
সামুদ্রিক মাছ), হাঁস-মুরগির মাংস। উদ্ভিজ্জ উৎস হলো পালং শাক, লাল শাক, কলমি
শাক, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, বিটরুট, বাঁধাকপি, ব্রোকোলি ও মসুর ডাল, ছোলা,
সয়াবিন, কাঠবাদাম, চীনাবাদাম, কাজু বাদাম, কিসমিস, খেজুর, আখরোট ইত্যাদি
খাবারে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। তাই গর্ভাবস্থায় এসব খাবার
গর্ভাবস্থায় শুরু থেকেই খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। গর্ভাবস্থায় এগুলো
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে।
২. ভিটামিন C যুক্ত খাবার খাওয়াঃ গর্ভাবস্থায় শরীরে রক্তের চাহিদা পূরণ করতে কিছু খাবার খেলে উপকার পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি। ভিটামিন C শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এটি আয়রনের শোষণ বাড়াতে সাহায্য করে। আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের সাথে ভিটামিন C যুক্ত খাবার খেলে শরীর সহজেই আয়রন গ্রহণ করতে পারে, যা হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সহায়ক।
ভিটামিন C এর অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। ভিটামিন C আয়রনের শোষণ
বাড়িয়ে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
সাইট্রাস ফল (কমলা, লেবু, মাল্টা, জাম্বুরা), পেয়ারা, আমলকি, আনার,
স্ট্রবেরি, আঙুর, কিউই, পেঁপে, আনারস ও টমেটো, বাঁধাকপি, ব্রোকোলি, শিম,
মটরশুঁটি, কাঁচা মরিচ, লাল ও সবুজ বেল পেপার ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন
সি রয়েছে। তাই গর্ভাবস্থায়ী এই খাবারগুলো শুরু থেকে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৩. ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12 গ্রহণঃ গর্ভাবস্থায় ফোলিক অ্যাসিড
(Vitamin B9) ও ভিটামিন B12 অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো রক্তস্বল্পতা
দূর করে নতুন রক্তকণিকা তৈরি করতে, শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক
বিকাশ নিশ্চিত করে। এদের ঘাটতি হলে গর্ভবতী মা ও শিশুর নানা শারীরিক জটিলতা
দেখা দিতে পারে। গর্ভধারণের আগে থেকেই ফোলিক অ্যাসিড সঠিক মাত্রায়
গ্রহণ করলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি কম হয়। ভিটামিন B12-রক্তস্বল্পতা দূর করে
স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে ও শরীরে শক্তি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা
করে।
ভিটামিন B12-এর অভাবে গর্ভবতী মায়ের দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ও স্মৃতিশক্তি কমে
যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৪০০-৬০০ mcg ফোলিক অ্যাসিড
গ্রহণ করা উচিত। শাকসবজি, ফলমূল, ডাল ও বাদামে প্রাকৃতিকভাবে ফোলিক অ্যাসিড
পাওয়া যায়। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ২.৬ mcg ভিটামিন B12 গ্রহণ করা উচিত।
গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ (বিশেষ করে টুনা, স্যালমন, সার্ডিন), ডিম, দুধ ও
দইয়ে প্রচুর ভিটামিন B12 পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12
সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা
উচিত।
৪. আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণঃ গর্ভাবস্থায় আয়রন (Iron) অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে, শরীরে অক্সিজেন
পরিবহন নিশ্চিত করে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে। গর্ভবতী মায়েদের শরীরে
আয়রনের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়, কারণ মায়ের শরীরকে শিশুর জন্যও রক্ত
তৈরি করতে হয়। যদি গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতি বেশি হয়, তবে অ্যানিমিয়া
(রক্তস্বল্পতা) হতে পারে, যা শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৩০-৬০ mg আয়রনের প্রয়োজন পড়ে। যদি রক্তস্বল্পতা
(অ্যানিমিয়া) থাকে, তবে ১০০-২০০ mg পর্যন্ত লাগতে পারে। সকালে খালি পেটে বা
খাবারের ১-২ ঘণ্টা পর খেলে শরীর ভালোভাবে শোষণ করতে পারে। ভিটামিন C সমৃদ্ধ
খাবারের সাথে (যেমন লেবুর রস, কমলা, পেয়ারা) খেলে আয়রন শোষণ ভালো হয়। অনেক
সময় আয়রন ট্যাবলেট খেলে গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিভাব বা কালো মল হতে
পারে। এই সমস্যা কমানোর জন্য ঘুমানোর আগে খেতে পারেন।
৫. পর্যাপ্ত পানি পান করা ও হালকা ব্যায়াম করাঃ গর্ভাবস্থায়
পর্যাপ্ত পানি পান এবং হালকা ব্যায়াম মায়ের ও শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এটি রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হিমোগ্লোবিন
বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং গর্ভকালীন নানা জটিলতা প্রতিরোধ করে। গর্ভাবস্থায়
রক্তের পরিমাণ ৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, তাই পর্যাপ্ত পানি পান করলে রক্ত
সঞ্চালন ভালো হয় এবং হিমোগ্লোবিন বাড়ে।
পানি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে, যা মাথা ব্যথা, দুর্বলতা ও ক্লান্তি দূর করতে
সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীরে অতিরিক্ত লবণ ও টক্সিন বের হয়ে
যায়, ফলে হাত-পা কম ফুলে। হজম ভালো রাখতে দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা
উচিত। হালকা ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি করলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং শরীর আয়রন
ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে। তবে যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই
ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা থাকলে গর্ভের বাচ্চার কি হয়
গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা থাকলে গর্ভের বাচ্চার জন্যও একটি গুরুতর হুমকি।
গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর বেশ কিছু
নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে
এবং জন্মের পর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় যদি মা পর্যাপ্ত পরিমাণ
রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও
প্রভাব পড়তে পারে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাকঃ
১. প্রিম্যাচিউর বা আগাম জন্মঃ প্রিম্যাচিউর জন্ম একটি জটিলতা, যা
মা এবং শিশুর উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য, যদি
গর্ভাবস্থায় সময়মতো যত্ন নেওয়া হয়। রক্তস্বল্পতা এই সমস্যার একটি প্রধান
কারণ, তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতার কারণে শিশুর পুষ্টির অভাব হতে পারে, যা
প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির (আগাম জন্ম) ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে শিশুর
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারে না এবং শিশুর সুস্থতা ব্যাহত হতে
পারে।
২. শিশুর গড় আয়ু কম হওয়াঃ গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তস্বল্পতা বা
হিমোগ্লোবিন কম থাকলে গর্ভের শিশুর গড় আয়ু কমে যেতে পারে। রক্তে
হিমোগ্লোবিন কম থাকলে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, ফলে শিশুর মস্তিষ্ক,
হৃদপিণ্ড, ফুসফুসসহ সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকভাবে গঠিত হয় না।
পরোক্ষভাবে শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং দীর্ঘমেয়াদী
বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উপর প্রভাব ফেলে। রক্তস্বল্পতা শিশুর জন্য পর্যাপ্ত
অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে শিশুর
অতিমাত্রায় কম ওজন হতে পারে । এটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা
সৃষ্টি করতে পারে।
৩. শিশুর বিকাশে সমস্যাঃ গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা (হিমোগ্লোবিনের
অভাব) থাকলে গর্ভের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নানা সমস্যা দেখা দিতে
পারে। কারণ, গর্ভাবস্থার সময় মায়ের রক্তই হলো শিশুর একমাত্র অক্সিজেন ও
পুষ্টির উৎস। যদি সেই রক্তে হিমোগ্লোবিন কম থাকে, তাহলে তা সরাসরি শিশুর
বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত এবং
অক্সিজেন না থাকলে, শিশুর মস্তিষ্কের এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যথাযথ
বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। এটি শিশুর বুদ্ধিমত্তা বা শারীরিক বিকাশ এ সমস্যা
সৃষ্টি করতে পারে।
৪. অক্সিজেনের অভাবঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কম থাকলে গর্ভের শিশুর
শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে, যা একাধিক গুরুতর সমস্যা তৈরি করে।
হিমোগ্লোবিন হলো এমন একটি প্রোটিন, যা রক্তের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে শরীরের
প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। তাই হিমোগ্লোবিন কম মানেই কম অক্সিজেন
পরিবহন এবং এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে গর্ভের শিশুর উপর। এটি শিশুর
স্নায়ুতন্ত্র এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৫. শিশুর জন্মগত অ্যানিমিয়াঃ শিশুর জন্মগত অ্যানিমিয়া হলো এমন একটি
অবস্থা, যেখানে নবজাতক শিশু জন্মের সময় থেকেই রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা
স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। এটি অনেক সময় গুরুতর শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে
পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের হিমোগ্লোবিন খুব কম থাকলে, তা সরাসরি শিশুর রক্ত
উৎপাদন ও অক্সিজেন বহনে প্রভাব ফেলে। জন্মের সময় যদি শিশুর রক্তে
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক না হয় (নবজাতকের জন্য সাধারণত
≥১৩ g/dL), তাহলে তাকে জন্মগত অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত ধরা হয়।
৬. প্রসবকালীন জটিলতাঃ গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতার কারণে প্রেসবের
সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা মায়ের ও শিশুর জন্য বিপজ্জনক হতে
পারে। যেমন – ব্রিচ (বাচ্চা উল্টো), ট্রান্সভার্স (আড়াআড়ি অবস্থান), ফলে
স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না। প্রসব ১৮-২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে মা ও
শিশুর ক্লান্তি ও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।প্রসবপথ খোলার জন্য জরায়ু ঠিকভাবে
সংকোচন না করলে বাচ্চা বের হতে পারে না। জন্মের পর জরায়ু সঠিকভাবে সংকুচিত
না হলে অনেক রক্তপাত হতে পারে, যা জীবনঘাতী। এই জটিলতাগুলো যদি সময়মতো
চিহ্নিত ও চিকিৎসা না করা হয়, তবে মা ও নবজাতকের উভয়ের জন্য মারাত্মক হতে
পারে।
৭. শিশুর রক্তস্বল্পতাঃ গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা থাকলে, শিশুরও
রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশুর রক্তস্বল্পতা হলো এমন
একটি অবস্থা, যেখানে শিশুর রক্তে হিমোগ্লোবিন বা লাল রক্তকণিকার পরিমাণ
স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। হিমোগ্লোবিনের ঘাটতির ফলে শরীরে পর্যাপ্ত
অক্সিজেন পৌঁছায় না, যার ফলে শিশু দুর্বলতা, ক্লান্তি, মনোযোগে ঘাটতি সহ
নানা জটিলতায় ভোগে।
৮.রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
হলো শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বল হয়ে যাওয়া, যার ফলে শরীর
সহজেই ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা অন্যান্য সংক্রমণের শিকার হয়। এটি
শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ, অপুষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের
মাঝে বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় মা যদি রক্তস্বল্পতায় ভোগেন, তবে তার
শিশুরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে এবং শিশুর শরীরে সংক্রমণের
ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
শেষকথাঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্তর যদি কমে যায়, তবে এটি মা এবং শিশুর জন্য কিছু
গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারাণত, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের
স্বাভাবিক স্তর ১১-১৪ গ্রাম/ডেসিলিটার হওয়া উচিত। যদি হিমোগ্লোবিনের স্তর ১০
গ্রাম/ডেসিলিটার বা তার নিচে চলে যায়, তবে রক্তের ঘাটতি বা অ্যানিমিয়া দেখা
দেয়। এই অবস্থায় মা'র শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের অভাব দেখা দিতে পারে এবং এটি
প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, শিশুর পুষ্টির অভাব, এবং প্রিম্যাচিউর
ডেলিভারি এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
তবে, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার ফলে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা
নির্ধারণের আগে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ডায়াগনোসিস ও পৃথক পরিস্থিতি
মূল্যায়ন করা উচিত। গর্ভবতী মায়ের রক্তের স্তর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে
আয়রন, ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এবং সময়মতো চিকিৎসকের
পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সঠিক খাবার গ্রহণ মা ও
শিশুর সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। আশা করছি গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে
রক্ত দিতে হয় এ বিষয়ে সঠিকভাবে জানতে পেরেছেন।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url